#খরচের_খাতায়
জমার উল্টোটা যদি খরচ হয় তবে আমি খরচে। এ আমার জিনগত বৈশিষ্ট্য।
আমার বাবা-মার ধাতে সেভিংস ব্যাপারটা কোনও কালে নেই। দু জনেই প্রচন্ড খরচে। এ আমাদের আত্মীয় স্বজন সকলে জানেন। এবং এ জন্য সারা জীবন আমাদের যৌথ পরিবারে বিস্তর জ্ঞান শুনেছেন ওঁরা। বাবা ছিলেন চরম আত্মভোলা, লেখাপড়ায় ডুবে থাকা মানুষ। আর মা প্রায় সংসারী। কিন্তু দুজনেরই কমন ইন্টেরেস্ট ওই খরচে। যেহেতু দুজনেই রোজগেরে ছিলেন তাই কেউ কারও খরচে মাথা ঘামাতেন না এই যা রক্ষে। আমি কিন্তু সে জন্য আজীবন ভেবেছি আমি প্রচুর জমাব। এবং আমার জীবনে এমন একজন ত্রাতা আসবেন যিনি আমায় জমানোর ব্যাপারে সম্যক পরামর্শ প্রদান করিবেন। পরামর্শদাতা প্রয়োজন কারণ আমি নিজেও ছেলেবেলা থেকে সমস্ত ব্যাপারে একটু আলুথালু। যারা আমায় চেনেন তারা জানেন নিত্য জিনিস হারানো আমার রুটিনের মধ্যে। টাকাও আমার মাঝে মধ্যেই হারায়, চুরিও যায়। এ জন্য আমি আমার চেয়েও বেশি আলুথালু আমার মায়ের থেকে প্রচন্ড বকাও খেয়েছি। আমি,আমার বাবা, মা এবং কিছুটা হলেও দিদির ভুলের গল্প নিয়ে আস্ত উপন্যাস হয়ে যেতে পারে। তাই বলছি টাকা হারানো যদি খরচের মধ্যে পড়ে তবে আমি বেজায় খরচে। আমার বাকি খরচের কথা আমি জানি না। আমার দিদি আমাদের তুলনায় কিঞ্চিৎ গোছানো। কিন্তু খরচের ব্যাপারে সেও সিদ্ধ হস্ত। এ পর্যন্ত জীবনের সমস্ত দামী ইচ্ছেগুলো ওই পূরণ করেছে। দিদির ছেলেমানুষ বয়েসে বিয়ে হবার পর আমার ২৬ বছরের জামাইবাবুকে দেখে আশা জেগেছিল এবার একজন জমানোর লোক এল।ব্যক্তিগত স্তরে জানি না তাঁর জমানোর কথা। কিন্তু কোনও কিছু পাঁচশো লাগলে উনি নিয়ে আসেন পাঁচ কেজি। কে জানে ভদ্রলোক খরচে কিনা। আর একজন আমার মেসোমশাই, সরকারী চাকুরে আমার মেসো বাজারে গেলে বাজারওলাদের তিনদিনের সংসার খরচ নিয়ে আর চিন্তা থাকে না। সে জন্য উনি বাজারে হেব্বি পপুলার।
কাজেই বোঝাই যাচ্ছে ছাত্র জীবনে আমি এমন একটা খরুচে আবহাওয়ায় বড় হয়ে উঠেছি। ছেলেবেলায় জমানো বলতে মাসিপিসিদের থেকে পাওয়া দশ বিশ টাকা দিদুর হাতে দিয়ে রাখতাম। ওইটেই আমার জীবনের একমাত্র শক্ত পোক্ত সেভিংস একাউন্ট।
ভেবেছিলাম চাকরি যদি করি তাহলে অতি অবশ্য টাকা জমাব। তা আমি আমার ব্যাচেলার চাকরি জীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছি একটা ভাড়া করা ফ্লাটে আমি আর আমার বোন সমা বান্ধবী সন্টুর (নবনীতা)সঙ্গে।সেখানে বেচারার কাজই ছিল আমার জিনিস গোছান। আমায় বেশ বকাবকিও করত অগোছালো স্বভাবের জন্য। আবার বকাবকি করে গুছিয়ে রেখেও দিত সব। প্রথম প্রথম এক সঙ্গে থাকতে শুরু করে আশায় ছিলুম এমন গোছানো গাছান মেয়ে ও নিশ্চয়ই আমাকে শেখাবে কি করে জমাতে হয়। ও হরি, এ মেয়েও যে জলের মত টাকা খরচ করে।
অগত্যা শেষ আশা ছিল বিয়ে। বিয়ে করে টাকা জমাব। কোথায় কি! আমার পতি দেবতা উচ্চ মার্গে বিচরণ করেন সর্বদা। আজ অব্দি এক পয়সা জমাননি। বললেই বলেন কি করবি জমিয়ে সর্বং খণিকং,খণিকং।।
বাকি রইল আমার শ্বশুর, শাশুড়ি। শ্বশুরমশাই রোজ পাঁচ রকম মাছ আর অকারণ জিলিপি কচুরি করে পেনশনের টাকা ফুরিয়ে ফেলেন জানি। বাকিটুকু অজানা। কিন্তু যার গল্প দিয়ে খরচের গল্প শেষ করব তিনি আমার শাশুড়ি।
তার দুখানা গয়নার দোকানের ছোট লাল ভেলভেটের ব্যাগ আছে। একখানা সবার সামনে বের করেন। আর একখানা গোপনে রাখেন। কেবল আমি জানি। তা উনি রোজ বাংলা ইংরিজি মিলিয়ে চারখানা খবরের কাগজ পড়েন কিন্তু ভাবেন এখনও দার্জিলিঙে গেলে পনেরো টাকায় উলের ব্লাউজ পাবেন। চারশো টাকায় টিস্যু বেনারসি কিনব এই আশায় গোপন আর ওপেন ব্যাগ নিয়ে রেয়ারলি গড়িয়াহাট যান আর সাতহাজার টাকার বাজার করে ফেরেন।কেবল নিজের জন্য নয় খুড়তুতো বোন থেকে বৌমার মাসি যে কেউ থাকতে পারেন সেদিনের বাজারের লিস্টিতে। ফিরে বরের কাছে অবধারিত বকা খাবেন, এ ভাবে পেনশনের টাকা নষ্ট করার জন্য।আমি মনে মনে ভাবি কে কাকে বলে! শাশুড়ি অভিমান করেন। জীবনে যতগুলো না করা চাকরি, এবং যেগুলোর করার সম্ভবনা ছিল সেগুলো এই সংসারের জন্য কেমন করে ছেড়েছেন তার কথা বলেন।সেখান থেকে উনি ফিরে যান সত্তরের গোড়ার দিকে ওনার কলেজ জীবনে, বসন্ত মালতি, ওলি সেন্ট আর ১৪ টাকার র সিল্কের ব্লাউজে। আর বলেন ঠিকই আছে যা ভেবেছি তার চেয়ে অল্প একটু বেশি খরচ হয়েছে বলো। আমি মনে মনে ভাবি উনি যা ভাবেন সেটা কি বলেন না, নাকি যা খরচ করেন সেটা মনে রাখেন না।
আমি কি আর করি বলি মা তোমার তো অনেক খরচ হয়ে গেলো আমি বরং তোমায় কিছু দি? আমায় চোখ টিপে বলেন নানা চিন্তা করো না, ওসব তোমার বাবাকে বলি।আমার ওই ব্যাগে গোপন অনেক টাকা আছে। ওই টাকা আমি ভুলেও খরচ করি না। তোমার বাবার থেকে কেঁদে কেটে নিই। আমি সরল বিশ্বাস থেকে ভাবি যাক একজন তো জমাতে পেরেছে আমার জীবনে।
তা এই মাসখানেক আগে আমায় শাশুড়ি বললেন আমায় একটা ভালো ব্যাগ দাও তো, আমার জমানো টাকার ব্যাগের চেন কেটে গেছে। এই টাকা জমানো ছাড়া সমস্ত ব্যাপারে আমার শাশুড়ি আমার চেয়েও বেশি অগোছালো । তাই বললাম দাও তোমার টাকাগুলো নতুন ব্যাগে গুছিয়ে রেখেদি। দেখলাম ওঁর গয়নার দোকানের লাল ব্যাগটা একেবারে পেট মোটা হয়ে ফুলে উঠেছে। ভেতর থেকে টাকা বের করতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। একবছর আগে ডেট পেরিয়ে গেছে এমন লন্ড্রির বিল থেকে ২০১৪ সালের ট্রেনের টিকিট অব্দি সব আছে। ভাবুন এটুকু ব্যাগে আর টাকার জন্য কতটুকুই জায়গা থাকে। ক্রমশ আশার আলো নিভছিল। তবু ভাবলুম জমানো টাকা কখানা দেখি। হায়রে দু এক খানা দুহাজারের নোটের পরেই এক গোছা পাঁচশ টাকার নোট। সবই নোট বাতিলের জমানার টাকা। আমি বললাম একি করেছ। তুমি এগুলো এখনও রেখে দিয়েছ। পাল্টাওনি কেন। বললেন পাগল তোমার বাবা জানতে পারবে আমার জমানো টাকার কথা, তখন? আমি বললাম তুমি রোজ এতগুলো খবরের কাগজ পড়, জাননা এই সব নোট বাতিল হয়ে গেছে। বললেন NRI রা পাল্টাতে পারে। তোমার দিদি এলে ওর হাতে দেব। আমি বুঝলুম ওঁর জমানো পুরোটাই খরচের খাতায়। কোন কচুবনে তপস্যা করেছিলুম কে জানে। আমার চেয়ে উপযুক্ত শ্বশুরবাড়ি আজ অব্দি ভূভারতে কোনও মেয়ের হয়েছে কি?
No comments:
Post a Comment