Monday, 11 November 2019

থাকুক বর্ষার রাত্রিরা


বন্ধ ঘরে শুয়ে থাকলেও আমি টের পাই আজ মেঘ করেছে। আমার মাথার যন্ত্রনা হয়। তাই অনেক বর্ষার সকালেই উঠি আমি খিঁচখিঁচে মেজাজ নিয়ে। অথবা ওঠার আগেই মনে হয় স্নান করার গামছা থেকে অন্তর্বাস সব আধশুকনো হয়ে থাকবে, কেমন গুমসুনি গন্ধ, বমি আসে আমার।রান্নার দিদি আজ বর্ষার জলে ডুব দেবেই,  তাই বর্ষার শর্টকাট ফরমুলা খিচুড়ি হবেই হবে। খিচুড়ি দেখলেই আমার দিল্লির হাসপাতালের স্মৃতি মনে পড়ে। বাবা গো সেই ওষুধের গন্ধমাখা খিচুড়ি।   
আমার তিনশ বছরের পুরনো শ্বশুরবাড়িখানা প্রত্যেক বর্ষারদিনে মনে হয় ছেড়ে চলে যাই। এতো বড়বড় ফ্লাট চারপাশে। ওগুলোর ভেতর এই ঘোর বর্ষাতেও শুকনো খটখটে।  অথচ এই বাড়িটাতে বৃষ্টি পড়লে  ঝুল বারান্দার হাঁড়ি বসাতে হয়। কড়িবরগার ফাঁক বেয়ে সেই হাঁড়িতে টুপটুপ করে জল পড়ে। এরা বলে এসব বাড়ির ঐতিহ্য, এসব ছেড়ে যাওয়া যায় না। আর আমার ভয় করে পা পিছলে পড়ে আমার এল ফাইভ আর এল সিক্সে ফাঁক হয়ে গেলে কাজ কর্ম সব বন্ধ। চার্নকের আমলের মেঝে খুঁড়ে বাথরুমে মার্বেল বসালেও কেঁচোগুলোও এই বাড়ির সদস্যদের মতই অনড়, এই পুরনো বাড়িখানা ছেড়ে যেতে চায় না কিছুতেই। বাথরুমের দেওয়াল ধরে হেঁটে চলে বেড়ায় আর দেওয়ালে আঠালো দাগ রেখে ওরা ডেস্টিনেশন খোঁজে। আমার স্নান করতে গিয়ে গা ঘিনঘিন করে। তাই বর্ষা পড়লেই আমি চোখখুলেই একের পর খুন করতে থাকি, আসিড ঢেলে ঢেলে। আর  লেডি ম্যাকবেথের মত কেঁচোর আঠালো দাগ দেখতে পাই হাতে। এইসব কেঁচো টেঁচো মেরে, দুর্গন্ধযুক্ত অন্তর্বাস পড়ে,  খিচুড়ি গিলে, হাঁটু ডোবা জল ঠেলে ডায়মন্ড হারবার রোডে গিয়ে অটো ধরি আমি।  কফ, থুতু, পেচ্ছাপ মেশা জল মাখা শরীর নিয়ে সারাদিন ডিও মেখে ঘোরা আমার পোষায় না আমার। মনে হয় আপিসে গিয়ে লাভ ক্ষতির হিসেব মেলান যায় না। সবটাই ক্ষতি মনে হয়। আমি তো আসলে সংসার নয়, অফিস নয় অন্যকিছু করতে চেয়েছি আজীবন। কি যে সেটা বর্ষার সকালে মনে পড়ে না কিছুতেই।সারাশীত সারা গ্রীষ্ম আমি কোনও ফুটপাতবাসীর কথা ভাবি না। প্রবল দাবদাহে অথবা ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় লোক মারা গেলে কেবল খবরের কাগজে পড়ি। কিন্তু বর্ষা হলেই গরীব মানুষের জন্য দরদ উথলে ওঠে আমার। আমি তখন সাম্যবাদী হয়ে যাই। নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারি ওদের সঙ্গে। সারাদিন বর্ষার কোনও রোমান্স আমার মনে জাগে না।
অথচ দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরি তখন বেহালার জমা জলগুলোকে  ভেনিস মনে হয়। শাশুড়ির হাতের গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি আর শ্বশুরমশায়ের আনা ইলিশের কথা মনে পড়ে। বাড়ি ফিরে আধভেজা গামছায় মুখ মুছতে মন্দ লাগে না। এসে পরনে জামা কাপড় ধুয়ে দিতে দিতে মনেই হয় না কাল এরা আধশুকনো থাকবে। বাথরুমের দেওয়ালে কেঁচোরা হেঁটে বেড়ালে দেওয়ালে কতরকম ডিজাইন তৈরি হয় আমি দেখি। আমার মুখোমুখি হয় কত কেঁচো, আমাদের হাসি বিনিময় হয়। ওরা ভাবতেই পারে না কাল সকালে আমার হাতে খুন হবে ওরা। আমিও ভাবি না তখন কোনও হত্যার কথা। রাত্রিবেলায় যখন অঝোর ধারে বৃষ্টি নামে তখন সারাদিনের লেগে থাকা আবর্জনা ধুয়ে যায় শরীর থেকে। কড়ি বরগা থেকে হাঁড়িতে টসে পড়া জলের শব্দে মনে হয় জলতরঙ্গ বাজছে।
বর্ষার রাতে আমি চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাই  সেই সব মেঘেদের যারা নির্বাসিত যক্ষের বার্তা নিয়ে উড়ে চলছে অলকায়। সেই সব উড়ন্ত মেঘেদের ব্যাকগ্রাউন্ডে মেঘমল্লার বাজে । আমি কখনও শান্তিনিকেতনের বর্ষা দেখিনি অথচ বর্ষার রাতে চোখ বুজলে দেখতে পাই কদম ফুল থেকে চুঁইয়ে পড়া জল। শুনতে পাই কে যেন গাইছে ”বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান"
এই বর্ষার রাতগুলোতেই আমার মনে হয় আমি মংপুতে কোনও কাঠের বাড়িতে বসে পাহাড়ের বৃষ্টি দেখছি। আমার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে মৈত্রেয়ী  দেবীর বাড়ি,  সেখান থেকে ভেসে আসে   "শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনী রে " বর্ষার রাতে আমি জঙ্গলের ট্রি হাউসে আছি বলে মনে হয়। সেখানে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আওয়াজ আর ঝিল্লির ডাক মিলে মিশে এক মায়াময় শব্দ তৈরি হয়।  মনে হয় আমি তো জীবনটা কেবল এমন শব্দ শুনেই কাটাতে চেয়েছি।  শুধু এ জন্যই বেঁচে থাকা এ জীবনে। মনে হয় "সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব" 
আচ্ছা কোনওদিনও বর্ষার সকাল না এলে কী হয়। থাকুক না বর্ষা জুড়ে কেবল রাত্তির। বর্ষার দিনগুলো বড্ড ডিপ্রেসিভ।

No comments:

Post a Comment