Saturday, 9 November 2019

অনিকেত

অনিকেত

এসি বাসখানা দুর্বার গতিতে ছুটছিল রেড রোডের ওপর দিয়ে। শীতের দুপুরের মিঠে রোদ ঠিকরে আসছিল আমার ডান কপালের ওপরে। নাকে আসছিল একটা মৃদু সুবাস। বোধহয় পাশে বসা অবাঙালি সহযাত্রিনীর গায়ের সুগন্ধি। ঘাড় ফিরিয়ে আঘ্রাণ নিতেই অল্প হাসলেন, প্রত্যুত্তরে আমিও হাসলাম, ওই অল্পই। খানিক আগেই ফেলে এসেছি  গাঢ় কমলা রঙের লেবু, মস্ত মস্ত আকারের চকচকে সবুজ বোম্বাই কুল, একরাশ বেলুন, রঙবেরঙরে সোয়েটার, কলকল করে কথা বলে যাওয়া এক ঝাঁক ছেলে-মেয়ে, গড়ের মাঠের ক্রিকেট প্রাক্টিস ,ময়দানের তাঁবু! শীতের কলকাতার রূপ যেন ঝরে ঝরে পড়ছিল সেদিন। পাশে বসা ভদ্রমহিলার বোধহয় কড়া এসিতে দিন রাত কাটানোর অভ্যেস, দেখলুম এই শীতের দুপুরেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গায়ের নরম শাল খুলে কোলের ওপর রেখে আমায় বললেন ‘আসলে গাড়ি আচানক খারাব হয়ে গেলো রাস্তায়, ড্রাইভার এই বাসডাতে তুলে দিলো।‘ আমি উত্তরে কেবল হাসলুম দেখে, নিজেই বললেন ‘আলিপুর নেবে যাবো, আপ?’ বললুম বেহালা। ‘আপনার বেগটাতো খুব সুন্দর! কুথা থেকে নিলেন?’ এইবারে একটু জোরের সঙ্গেই বললুম এখানকার ব্যাগ নয় এটা। USA থেকে আনা। সহযাত্রিনী কথার সমর্থনে বললেন ‘দেখেই বুঝেছি, আমার সেম বেগ আছে, দুবাই থেকে লিয়েছিলাম।‘ আমি উত্তর দেবার আগেই বললেন ‘এ দিকটায় বড্ড ভিড় আছে, আমার মাহকার কছে এতটা ভিড় নেই’ আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে বললেন ‘লাউডন স্ট্রিট’।আমি বললুম হ্যাঁ আমিওতো ফাঁকায় ফাঁকায় বড় হয়েছি, বড্ড হাঁফ ধরে। ভদ্রমহিলা উৎসাহিত হয়ে বললেন ‘আপনিও! ওই দিগটা এখনো  অনেক ভালো আছে বলুন। সব কেমন কাছে। কুথাও যাবার ঝামেলা কম!’
 শীতের কলকাতা আশ্চর্য ম্যাজিক জানে বটে! আজন্মকাল সিঙ্গুর, হুগলিতে বেড়ে ওঠা আমাকে একটা এসি বাস, একটা ইম্পোটেড ঘড়ি আর ব্যাগ অনায়াসে বানিয়ে দিলো রডন স্ট্রিট অথবা লাউডন স্ট্রিটের বাসিন্দা। মনে মনে গান ভাঁজছিলুম ভুতের রাজা দিলো বর... আবার প্রশ্ন ‘আপনার নাম কি আছে? ম্যারেড?’ নাহ আর কথা বলা যাবে না। বাস দ্রুত এগোচ্ছে। মিস করে যাবো শীতের কলকাতাকে। তাছাড়া বেশি বকলে কমে যেতে পারে ব্যাগের মহিমা। না শোনার ভান করে তাকিয়ে রইলুম বাইরের দিকে। পিজির এদিকটাকে মনে হয় হসপিটাল রোড বলে! বেশ আভিজাত্য আছে রাস্তাগুলোয়। ভাগ্যিস সম্পর্কসূত্রে ঠিকানা বদলে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছি। ঝকঝকে কলকাতাকে উপভোগ করতে করতে কেন যে  সীমাবদ্ধ ছবির ডায়ালগ মনে এলো কে জানে, “ রাস্তাঘাট দেখলে বোঝা যায় এখানে এতো লোক মরটরে!” এই সময় এই সংলাপ মনে পড়ে কারও,  দিনকে দিন সিনিক হয়ে উঠছি আমি, দিব্যতো আছে বাপু সবকিছু! হঠাৎ গেটের কাছে মৃদু গুঞ্জন হতে তাকালুম । দেখলুম পায়ে প্লাস্টিকের চটি আর সামান্য মলিণ ডোরাকাটা শার্ট পরা এক ভদ্রলোককে কন্ডাক্টর বলছেন ‘উঠলেই পঁচিশ টাকা ভাড়া, দিতে পারবে তো’ ভদ্রলোক মৃদু স্বরে বললে ‘ও বাবা এতো!” পকেট থেকে মানিপার্স বের করে এগিয়ে দিলেন একটি একশ টাকার নোট। “আর নেই, একটা দশ টাকা আছে।‘’  জানি এবার বিতন্ডা চলবে। অস্বস্তি কাটাতে জানলার বাইরে চোখ দিলুম।  ওমা!আলিপুর জেলের দেখি রঙ বদলেছে, লাল থেকে নীল। ততক্ষণে বাইরের ঝকঝকে রোদটা একটু ম্লান হয়েছে। আমার কপালে আর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। বাস খানিক এগোতেই দেখলুম অভিজাত রাস্তাগুলো ক্রমশ কেমন মধ্যবিত্ত হচ্ছে। দেখলুম এক বৃদ্ধ এক পাঁজা ডেচকি নিয়ে মাজতে বসেছেন রাস্তার কলে। শীতে না বয়েসের ভারে জানি না, ওঁর উদোম পিঠের চামড়াটা কেমন তিরতির করে কাঁপছে। চোখ ফিরিয়ে নিতেই নাকে এলো সেই মৃদু সুবাস। জানতে চাইব ফরাসি সুগন্ধি কি না, থাক। আমার গায়েও লাগানো আছে ডিউটি ফ্রি থেকে কেনা আডিডাস আক্যোয়া, কম কি। আবার বাইরে দিকে তাকাতেই দেখলাম সুদর্শন ট্রাফিক সার্জেন্ট বাইকের কাছে হাত নিচু করে কুড়ি টাকা নিয়ে পকেটে পুরলেন। চায়ের দোকানের পাশে ঘুপচি গলিতে এক কিশোরের প্যান্ট টেনে খুলে দিচ্ছে একটা লুঙ্গি পরা লোক, ছেলেটি লজ্জায় ত্রাহি ত্রাহি চেঁচাচ্ছে  আর লোকটা লাল ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসছে। লালবাতির মুখে বাস দাঁড়িয়ে গেলে দেখলুম কমলা লেবুর ঝুড়ি নিয়ে রাস্তা পেরনো এক বৃদ্ধাকে কোনও নিয়ম না মানা একটা অটো ধাক্কা দিয়ে ছুটে চলেছে। আর ছিটকে পড়া বুড়ির ফুটপাতে মাথাখানা লেগে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। রাস্তায় ছিটিয়ে থাকা কমলা লেবুর ওপর দিয়ে এগিয়ে গেলো আমাদের বাস। হয়তো লেবুগুলোকে চাকার তলায় পিষে তারপর এগোল। 
হঠাত করে শীতের কলকাতা এমন হিম শীতল হয়ে গেলো কেনো! এসি কি খুব জোরে চলছে? বাইরেটাও কেমন ঝাপসা হয়ে এলো, আমার চশমার কাঁচে কি বাষ্প জমলো? নাকি বাসের জানলায়। ভাবলুম জানতে চাই ভদ্রমহিলার কাছে। চেয়ে দেখলুম পাশে বসা ভদ্রমহিলার তখন উঠি উঠি সময় হয়েছে। আমার কেনো যেন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল নাম জানতে চেয়েছিলেন না? আমি না কলকাতার কেউ নই। আমি সিঙ্গুরের নীলা। তারপর মনে হল এখন যখন বাপের বাড়ি যাই দেখি একটু আগে দেখা মানুষরাই  ভিড় করে আছে সেখানে, কেবল নাম ঠিকানা বদল হয়েছে। ভদ্রমহিলা নেমে যাবার জন্য সিট থেকে উঠলেন। আমার দিকে চেয়ে বললেন চলি। আমি দু পলক চেয়ে বললাম আপনি নাম জানতে চেয়েছিলেন না? আমার নাম অনিকেত। ‘বহত খুবসুরত’। ভদ্রমহিলা দ্রুত এগোচ্ছিলেন দরজার দিকে। চিৎকার করে জানতে চাইলাম অনিকেত মানে জানেন। ঘাড় ফিরিয়ে বললেন ‘নেহি’। অনিকেত মানে যার কোনও বাসা নেই। আলিপুর থেকে বেহালা আর কতক্ষণ কে জানে, বড্ড শীত করছে যে।

No comments:

Post a Comment