Monday, 4 November 2019

ইফতার



দিন চারেক আগে সোমা দি, ফারহাদ দার দোকানে গেছিলাম  নিউমার্কেটে। কিছু কাজ ছিল ওখানে। সঙ্গে টুকটাক গল্পগাছাও হচ্ছিল। ঈদের খদ্দেরদের বেশ ভিড়। ওরাও বিকেল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠছিল। 'আজ চলি' বলে পাঁচটা নাগাদ উঠে পড়লাম। সোমা দি বলল 'আর ঘন্টাখানেক থেকে যা একদম আমাদের সঙ্গে ইফতার করে যাবি। '  'পরে একদিন হবেখন' বলে এগিয়ে গেলাম দোকান থেকে।

 বেরিয়ে দেখলাম বেশ ভিড়। যাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন অধিকাংশই মুসলমান। বুঝলাম ঈদের কেনাকাটার ভিড়। হগ মার্কেটের সামনে ব্যাগের দোকানগুলোর নিচে বসে  কয়েকজন মাথায় ফেজ টুপি পরে  বিরাট থালায় ফল কোঁচাচ্ছেন। কলা, খেজুর,  তরমুজ,ছোলা আরো যেন কিসব রাখা। এক ভদ্রমহিলা  ফোনে কাকে যেন জোরে জোরে বলছেন 'এখন গলা শুকায়ে কাঠ, ইফতার হলে ফোন করব' তার পাশের মেয়েটি বোরখার ওপর দিয়ে একটা সোনালী হার গলায় দিয়ে দেখছে মানায় কিনা, আর ইমিটেশনের দোকানদার আয়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে।  মেয়েটির পায়ের কাছেই কাঠের গাড়ি চেপে একটি মুসলমান দরিদ্র  হাত পেতে বসে আছেন, সে জানে হার কেনার পর মেয়েটি দশটি টাকা হলেও দেবে ওঁর হাতে। বড় রঙিন লাগছিল সমস্ত ছবি। আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে লিন্সে স্ট্রিটের দিকে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ ওই ভিড়ে একটা বাইক কালো ধোঁয়া উড়িয়ে আমায় প্রায় ধাক্কা মেরে চলে গেলো। বাইকে বসা ছেলে দুটির একজনেরও মাথায় কোনো হেলমেট নেই।  বাইকটারর থেকে বেরোন কালো ধোঁয়া আমার নাক মুখ দিয়ে খানিক ঢুকে গেলো। একে এতো ভিড়, তার মাঝখানে ওই বেপরোয়া বাইক চমকে দেওয়ায় আমার কষ্ট হচ্ছিল নিশ্বাস নিতে। পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন 'ওদের কিছু বলতে পারবেন না, তা হলেই দাঙ্গা। ওরা কোনো নিয়ম না মানলেও সরকার চুপ, এই রাস্তায় কি গাড়ি চলে! কিন্তু ওরা চালাবে। তারপর দেখুন মাথায় ওদের নিজেদের টুপি আছে ব্যস হেলমেটের দরকার নেই' ভদ্রলোক আমার মাথায় সিঁদুরের রেখা দেখে বুঝেই গেছিলেন আমি 'ওরা' নই। কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যাই আমি। কিন্তু বাইকের ওই কালো ধোঁয়া আর অপরিচিত ভদ্রলোকের শব্দগুলি কেমন কুন্ডুলি পাকিয়ে আমার বুকে চেপে বসছিল ক্রমশ। আমার রীতিমত শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল।

হঠাৎ আমার স্কুলের সহপাঠী দুই ভাই বোনের কথা মনে পড়ল। ফারজানা আর মুস্তাক। ওদের নিয়ে একবার বন্দনা  বলে একটি মেয়ের বাড়ি গেছিলাম সরস্বতী পুজোর দিন। বন্দনার মা আমাদের থালায় সাজিয়ে ভোগের খিচুড়ি দিয়েছিলেন। ওরা তা খেতে অস্বীকার করে, বলে ’আমরা প্রসাদ খাই না, প্রসাদ খেলে পাপ লাগে' কাকিমা তারপরেও নানা রকম খাবার প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, বলছিলেন 'অমুকটা খাও, ওটা প্রসাদ না' ওরা সমানে খেতে অস্মমত হয়। 'পূজা বাড়িতে আমরা খাই না' এই বলে।  মনে পড়ছিল বন্দনার মায়ের অপ্রস্তুত শুকনো মুখখানার কথা। মনে পড়ল সহকর্মী আজহারের কথা, কোনো দিনও আমাদের দেওয়া একটুকরো খাবারো খায়নি যদি প্রসাদ হয়, অথচ ওর আনা কাবাব অনেকেই গান্ডে পিন্ডে গিলেছে। ভেতরে ভেতরে হিলহিল করে বলে উঠি আমরাই যত আদিখ্যেতা করি। ওরা তো লিবারেল হয় না। ভালো হয়েছে ইফতার করিনি।

 মার্কেটের ভেতরে ঢুকে দেখি অধিকাংশই মুসলমান দোকানদার, দোকানের সামনে অনেকেই ইফতারের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কানে ভেসে আসে ' ওয়ে নুরুল শুন নারায়ন কি আম্মা নে বেগুনী ভেজা ও রাখনা মেরে লিয়ে, সব খুদ মাত খা লেনা' আমি ঘুরে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মনে হল সামান্য কালো ধোঁয়া বুক থেকে বেরোল বুঝি। গুটিগুটি পায়ে একটা জামাকাপড়ের দোকানের দিকে এগোই, দেখি একটি মুসলমান পরিবার কেনাকাটায় ব্যস্ত। এক ভদ্রলোক বছর পঁতাল্লিশ, বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা আর তিনটি বাচ্ছা। তার মধ্যে বড় মেয়েটি বছর চোদ্দ হবে ওড়না দিয়ে মাথা মোড়া।কালোর ওপর মুখখানা ভারি মিষ্টি। পরিবারটিকে দেখে খুব অস্থাপন্ন নয় বলেই আন্দাজ হচ্ছিল। বড় মেয়েটি বাবার কাছে বায়না করে ’ বাবা দুটা সালোয়ার কামিজই দাও' মা বকা দেয়। ’ এতো বড় মেয়ে বায়না করলে ভাইরা  কি করে' মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ’ এই একটা জামা!  দুর্গা পুজোর  সময় কি পরে বের হব তবে, গত বছরও পুরান জামা পরে ঠাকুর দেখতে গেছি' মা বলে ' পুজোর সময় আবার কিনে দিবে আব্বা। দেয় তো তোদের, এখন থিকে কিনে কি হবে'। ওরা হাঁটতে হাঁটতে অন্য দোকানের দিকে এগোয়। আমার বুক থেকে একরাশ কালো ধোঁয়া উড়ে যায়।

যখন মার্কেটের থেকে বেরিয়ে হাঁটছি সকলে ইফতার সারছে। এক থালা থেকে বসে গোল হয়ে খাচ্ছে সকলে। লাইট হাউসের  সামনে দেখলাম প্লাস্টিকের গ্লাসে লাল লাল সরবৎ বিলি করছে ইফতারের জন্য। ওখানটা খুব ভিড়। সারাদিন শুকিয়ে থাকা মানুষ চোঁ চোঁ করে খাচ্ছে সেই জল, নাকি পানি বলব! আজকাল তারকেশ্বরের জলযাত্রীদের জন্যও এই ব্যবস্থা দেখি। হাইজিন টাইজিন ইত্যাদি ভেবে কোনো দিনও খাইনি। বড় বুকটা শুকিয়ে ছিল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম ’ আমায় একটু পানি দিন’ কে যেন বলল 'দিদিকে জল দে। ' আমার হাতে ওই প্লাস্টিকের গ্লাস দিতেই  এক মহিলা হাতের ওপর দু চারটে ভিজে ছোলা দিল। চেয়ে দেখলাম আপাদমস্তক মোড়া বোরখায়। তবুও যেন একটা মৃদু হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম। 

ছোলা চিবোতে চিবোতে এগোচ্ছিলাম, সোমা দি ফারহাদ দার দোকানে যাবার সিঁড়িটা চোখে পড়ল।   মনে হল সোমাদির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কিছু না হোক কুড়ি বছরের, আর সেই সুবাদে ফারহাদ দাকেও বছর বারো, চোদ্দ চিনি। কতবার ওদের দোকানে এসেছি। কিন্তু ঈদের সময় বোধহয় আসা হয়নি কখনো। সোমা দি বহু বার ঈদে যেতে বলেছে ওর বাড়ি, জীবনের নানা ব্যস্ততায় সেটাও গিয়ে উঠতে পারিনি। আক্ষেপ হচ্ছিল ইস ঘন্টাখানেক থেকে এলেই হতো। সেই তো এ চত্ত্বর থেকে বেরোতে বেরোতে বেশ দেরিই হলো।  হঠাৎ দেখি সেই পেছন থেকে ফিসফিস করে কথা বলা ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। হাতে আতিব বা আফতাব কি যেন লেখা প্যাকেট। হাসি পেলো আমার। নাক কানটা  ভালো করে মুছে নিলাম, যেখান দিয়ে একরাশ কালো ধোঁয়া আর ফিসফিসে, হিলহিলে শব্দগুলো ঢুকেছিল।  জনস্রোতের সঙ্গে এগোতে এগোতে ভাবছিলাম আমরাও তো কম করিনি। মুসলমান বাড়িতে আমার কজন পূর্বপুরুষ খেয়েছে, আমরাও তো বাড়িতে আসা মুসলমান অতিথির খাওয়া থালা বাটি রান্না ঘরে ঢোকাইনি। আমরাও ঈদে যাইনি ওরাও দুর্গা পুজোয় আসেনি। কিন্তু এই 'ওরা' এই ’আমরাই' কী ভারতবর্ষ নাকি ভারত মানে সেই নারায়ণ নামের কর্মচারী যার মা তৌফিককে বেগুনী ভেজে পাঠায় ইফতার করবে বলে, নাকি দোকানের সেই মেয়েটি যে ঈদের জামার সঙ্গে দুর্গাপুজোর জামারও বায়না করে, নাকি ভারতবর্ষ মানে সোমা দি ফারহাদ দার সন্তান যাদের বাবার সঙ্গে ঈদ পালনও  আছে আবার শ্রীরামপুরে মামাবাড়ি গিয়ে ঠাকুর দেখাও আছে। নাকি আমার  ভাররবর্ষ মানে শ্রান্ত পথিকের হাতে পড়া চার পাঁচটি ভিজে ছোলা অথবা বাতাসা  আর আর এক গেলাস লাল শরবৎ। ঈদের আগাম শুভেচ্ছা!  সকলকে। 'ওদের' তো বটেই আমাদেরও।

No comments:

Post a Comment