আমাদের দেশ কনসেন্টের দেশ। কতটা খাবো, কতটা ঘুমোব, কতটা সাজব, কি কথা বলব এমন কি কার সঙ্গে এবং কবে থেকে যৌনতায় লিপ্ত হবে এসবই ঠিক করে দেন অভিভাবকরা। সচেতন পরিবারগুলি ছেলেমেয়েদের দাঁত মাজতে, নখ কাটতে, হাত ধুতে, বড়দের সম্মান করতে শেখান অথচ যৌনশিক্ষা তাঁরা দেন না। ফলত বহু ধেড়ে বয়েস পর্যন্ত অধিকাংশ যৌন আচরণ সম্পর্কে ছেলে মেয়েরা থাকে অজ্ঞ এবং যেটুকু তারা বন্ধুবান্ধবদের থেকে এবং ইদানিং ইন্টারনেট থেকে শেখে তার অনেকটাই ভুল। আমার অবাক লাগে যখন একটি মেয়ে গল্প করে করে 'ক্লাস নাইনে যখন আমার পিরিয়ডস হয় আগে জানতামই ব্যাপারটা কি, আমি না জানো ভয় পেয়ে গেছিলাম কি প্রচন্ড', তখন মেয়েটিকে ন্যাকা না ভেবে ইচ্ছে হয় তার বাবা মাকে মুর্খ ভাবতে। আমার এক বান্ধবীর ক্লাশ টুয়েলভে বিয়ে হয়েছিল সে যখন বলে বিয়ের আগে জানতাম চুমু খেলেই বাচ্ছা হয়ে যায় তখন ভাবি ওর বাবা মা কি ওকে বলি দেবার জন্যই জন্ম দিয়েছিল! বিয়ের আগে সামান্য শিক্ষাটুকুও দিয়ে দেয়নি। অথচ একটি কিশোরী মেয়েকে সোজা তুলে দিল লাইসেন্সড বিছানায়। আর সেই মেয়েই যখন তার ক্লাস টেনে পড়া কিশোরী কন্যা 'বাচ্ছা কি করে হয় জানে না এতো সরল' বলে বুক ফুলিয়ে গল্প করে তখন ভাবি হায়রে এই ন্যাকামি আর মুর্খামি কতদিন চলবে। এদের কে বাঁচাবে কামুকদের হাত থেকে। জানি প্রচন্ড যৌন শিক্ষা থাকলেও ধর্ষকরা, কামুকরা নির্মূল হয়ে যাবে না দেশ থেকে। তবু একটা মেয়ের অবাঞ্চিত স্পর্শটুকু বা যৌন ইঙ্গিতটুকু বোঝবার বুদ্ধি তো হবে। এই মি টুর ঝড়ে যে সমস্ত কামুকরা চিহ্নিত হয়েছেন তাদের কারও সঙ্গে কর্মসূত্রে বা কোনও রকমের পরিচয় থাকলে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এঁরা কেউ সাধু পুরুষ নয়, সামান্য সময়েই সেটার একটা ধারণা পাওয়া যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে । অথচ এদের খপ্পরে পড়ছে অজস্র, শৈশব, কৈশোর, যৌবন। যৌন ক্ষুদা এবং বিকার লুকিয়ে রাখা খুব শক্ত। কিন্তু যে সমস্ত মেয়েরা প্রতারিত, নিপীড়িত হয়েছেন তাঁরা সে ইঙ্গিতটুকু ধরার মত পরিনত হননি এটা আমাদের শিক্ষার দুর্ভাগ্য এবং অভিভাবকদের অজ্ঞতা। আর মেয়েদের নিয়ন্ত্রিত থাকতে থাকতে না বলার শক্তি তৈরি না হওয়ার ফল। সদ্য ঘেরাটোপ মুক্ত মেয়েরা দ্রুত পৃথিবী জয় করতে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ছেন কারণ আবারও বলি যৌন ইঙ্গিত না বোঝার অজ্ঞতা।
তবে এটা আশার কথা মেয়েরা যৌন নিপীড়ন নিয়ে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার হয়ে উঠতে পারছে। যৌন নিপীড়ন পুরুষদেরও হয়। বিশেষত পেডোফেলিকদের বাছাই তালিকায় বাচ্ছা ছেলেরা প্রায়শই থাকে। আর এটাও জেনে রাখবেন পুরুষদের দ্বারা পুরুষদের যৌন নিপীড়ন ঘটে অনেক বেশি। কিন্তু কজন পুরুষ সে ক্ষেত্রে হ্যাশ ট্যাগ মি টু দিয়ে সে কথা জানাচ্ছেন? উল্টে প্রগতিশীল পুরুষেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বোনি আমি তোমার সঙ্গে আছি বলে রঙ্গ করছেন আর আবডালের আসরে গপ্প করছেন এতোদিন এই মেয়েরা কি করছিলো, এতোদিন বলেনি কেন? আরে তবু তো এতোদিনে বলে উঠতে পারছে মেয়েরা আপনারা তো এখনো নিশ্চুপ। উলটে বাড়ির মেয়েরা যখন তাঁর হেনস্থার কথা জানাচ্ছেন পরামর্শ দিচ্ছেন চেপে যেতে। অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ আর পৌরুষ আলাদা, কিন্তু পুরুষ আর কাপুরুষে খুব ফারাক করতে পারবেন না।
মেয়েরা প্রকাশ্যে বলার সাহস যেমন অর্জন করেছে না বলার শিক্ষাও অর্জন করুক। কামুক পুরুষ নিজেকে খুব বেশি লুকিয়ে রাখতে পারে না। সামান্য ইঙ্গিতকে হালকা চালে নিয়ে যদি ভাবেন এইখানেই থেমে যাবে ভুল ভাবছেন। আপনি মা হলে সন্তানকে প্রথম থেকে যৌন শিক্ষা দিন। শিশুকে স্পর্শ এবং কিশোরীকে যৌন ইঙ্গিত ও আচরণও বোঝান। অনভিপ্রেত বলপ্রয়োগ, আচমকা ধর্ষন এসব ধর্ষকের মৃত্যু ভয় ছাড়া বন্ধ হবার উপায় আমি জানি না। তবে এটা বলতে পারি অপরাধী চিহ্নিত হতে ভয় পায়। তবে পরিকল্পিত অসভ্যতা বা ট্রাপে পড়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব। মেয়েদের না বলার শক্তি অর্জন করতে হবে। আর নিজেকে অপবিত্র, দোষী ভাবা বন্ধ করতে হবে, যৌন বিকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন।শোস্যাল প্লাটফর্ম সে জায়গা নয়। প্রতিবাদের সঠিক ভাষা খুঁজে বের করতে হবে একজোট হয়ে। সে ভাষা,এখনও অনাবিষ্কৃত। যদি বাড়ির লোক বলেন যা হয়েছে চেপে যাও শুনবেন না। চেপে গেলে বারেবারে মুখোমুখি হতে হবে বিকৃতের।
আমি জানি এ জগতে এমন মানুষও আছেন যাদের অক্ষরেও কাম জেগে ওঠে। এই লেখার সামান্য নিরিহ কতগুলি শব্দও তাদের উত্তেজিত করতে পারে, এইসব ভেবে আমি লিখিনা কখনও, ইচ্ছে হয়না। আর সোশ্যাল মিডিয়ার হঠাৎ প্রতিবাদে গা ভাসানোতেও আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে 'প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ আর চুপ নয় আর।
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায় (২৪.১০.১৯)
নিজের যা মনে হয়
No comments:
Post a Comment