নাটক পাঠযোগ্য সাহিত্য তো বটেই।কিন্তু গল্প উপন্যাসের সঙ্গে তার মূল তফাত হল অধিকাংশ নাটক লিখিতই হয় নির্মিত হবার জন্য বা প্রযোজিত হবার জন্য। একথা অস্বীকারের উপায় নেই নিজের লিখিত নাটক মঞ্চের ওপর অভিনীত হতে দেখলে যে তৃপ্তি অনুভূত হয় তা প্রায় সমস্ত যুগের সমস্ত নাটককারের ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু যদি নাটকলিখিয়ে তাঁর নাটকের অদ্ভুত, বিকৃত বা প্রায় কোনও ব্যাকরণ না মেনে পরিবর্তত রূপ দ্যাখে, তার কষ্ট এবং হতাশাও সর্বকালের সমস্ত লিখিয়েদের ক্ষেত্রে একই রকম সত্যি।
আমি নিজে নাটক লেখার ক্ষেত্রে দেখেছি অনেক নাট্যদলই সম্পাদনার নামে মূল নাটকটির যা হাল করেন তা নাটককারের পক্ষে কেবল যন্ত্রনার নয় রীতিমত অপমানের। নাটকলিখিয়েরা কিন্তু কোনোরকম চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও বিনা দ্বিধায় তা মেনে নেন। আমি নিজেও একাধিকবার তা করেছি। মানছি প্রযোজনার প্রয়োজনে লিখিত নাটক ক্ষেত্রবিশেষে বদলাতে হতে পারে, কিন্তু তা নাটককার বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তাঁর অনুমতি ছাড়া বা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কী করে সম্ভব হয়! অথবা তাঁর অবর্তমানে উত্তরাধিকারের অনুমতিও অন্তত নেওয়ার প্রয়োজন বলেই মনে হয়। এমন কি কপিরাইট চলে যাওয়া নাটকের বেলাতেও সে নাটক নিয়ে যা খুশি করা যায় নাকি ভেবে দেখাবার কথা। আমার ধারণা গল্প উপন্যাসের নাট্যরূপের ক্ষেত্রেও এমনটাই সত্যি। এতে নাটককার বা লেখকদের নিজেদের প্রতিবাদ তো নেই বটেই, তাঁদের স্বজন বন্ধুদেরও অধিকাংশ সময় নির্মাতার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। বাঙালি লেখকদের দূর্ভাগ্য যে তাঁদের নিজেদের কোনো সংগঠন নেই, সংগঠন তো দূরের কথা কোনোরকম ঐক্যমত্যই নেই। আইন তো নেই বলাই বাহুল্য।ফলে অমুক অবলম্বনে নির্মিত বা সম্পাদিত বলে যা দেখি তা হতবাক করে দেয়, অপমানিত করে। এমনও দেখেছি অমুকের নাটক অবলম্বনে অমুকের নাটক লিখতে লিখতে মূল নাটককারের নামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ছেপে বেরোন নাটক একেবারে অনুমোদন ছাড়া পাড়ার দল অভিনয় করছে এ অভিজ্ঞতা নেই এমন কথা হলপ করে কজন নাটককার বলতে পারবেন আমার সন্দেহ আছে। এই সমস্তই কোনোরকম ব্যবস্থাগ্রহণ না করেই মেনে নেন নাটক লেখকরা।
অথচ ভেবে দেখুন নাটক কিন্তু বেশিরভাগ সময় থেকে গেছে নাটককারের নামে। ইস্কাইলাস, সোফোক্লেস, ইউরিপিদিস,শেক্সপিয়রের ইবসেনের নাটক, রবীন্দ্রনাথ, তুলসী লাহিড়ি, বিজন ভট্টাচার্য, বাদল সকারের নাটক। জীবিত প্রখ্যাত নাটককারদের নাম না করেই বলা চলে ভবিষ্যতে নাটক যদি বেঁচে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের নামেই বেঁচে থাকবে। অথবা আরও যাঁরা এখন নাটক লিখে চলেছেন তাঁদের বহুজনের ক্ষেত্রেও এটাই সত্যি হবে এইটকু স্থির বিশ্বাস।
অতয়েব যাঁরা আমরা নাটক লিখি তাদের কিসের এতো আত্মবিশ্বাসের অভাব তা ভেবে দেখবার সময় এসেছে। ভুললে চলবে না লেখকরা কিন্তু গোটা নির্মাণটির ভ্রূণ। এখনও পর্যন্ত আমাদের নির্মানের ধরণে লেখকের অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। এ সময়ের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, আমাদের গর্ব আমাদের সম্পদ ক্লাসিক প্লে অথবা ধ্রুপদী নাটকগুলি যেন বিকৃত না হয় সেটুকু দেখার মত শিরদাঁড়ার জোর আমরা অন্তত রাখতে পারি, তাইনা?
No comments:
Post a Comment