নানা রকম বিলাসী ঘর থাকে। যেমন কিছু বিলাসী ঘরে কোনও আড়ম্বর থাকে না। সেই সব ঘরের মালকিনরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম. এ পাশ করেও অথবা না করে লেডিব্রেবোন ডিপ্লোমা নেয় অথবা জোগাড় করে টেক্সটাইল কলেজের সার্টিফিকেট। এরা চোদ্দ,চব্বিশ অথবা চুয়াল্লিশ বছর আগে দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে ঢোকার পর থেকেই নতুন ঘরকে বিলাসী বানাতে তৎপর হয়। নিজে হাতে পর্দায় ফেব্রিক করে। টেবিল ক্লথের কোণে কাশ্মীরি স্টিচ দিয়ে রঙ্গন ফুলের ঝাড় আঁকে, সাবেকি টিপটের জন্য কুরুশের টিকোজি বোনে, পড়ে থাকা বাঁশের টুকরোকে কুঁদে কুঁদে ফুলদানি বানায়, তাতে বেঁচে যাওয়া সাদা,নীল ফেব্রিক কালার দিয়ে নকশা কাটে। নারকেলের মালা দিয়ে অ্যাশট্রে বানায়। মেমসাহেব পুতুল কেনে মেলা থেকে, তারপর সে পাতি পুতুলকে ভাঙা বোতাম দিয়ে রেড ইন্ডিয়ান সুন্দরী বানায়। এইসব মালকীনদের শাড়ি গয়নার চেয়েও বেশি সাধ থাকে ভালো পোর্সেলিনের ডিশের আর ফুলতোলা হ্যান্ডমেড বেডকভারের। পড়ে থাকা হরিণঘাটার শিশিতে মানিপ্ল্যাণ্ট লাগিয়ে এরা ঘরকে স্বর্গের বাগান বানাতে পারে। টিনের পাউডার কৌটো ফুটো করে এরা পয়সা জমায় আর বেড়াতে গেলে তা দিয়ে রাজস্থানি ওয়াল হ্যাংগিন কেনে। এইসব বাড়ির মালিকরা বৌকে ভালোবাসে খুব, তাই মালকিনদের অভিযোগের সুযোগ থাকেনা। কেবল একটাই অভিযোগ ’ডিভানের কুশনগুলোকে দু ভাঁজ করে মাথার তলায় দিয়ে শুয়ে পড়ে ফাটিয়ে তুলো বের করে দাও কেন তুমি' অথবা ’লোক এলে কেন ঘর সাজাতে দেবেনা বলতো' ঘরের মালিক বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে কেবল উত্তর দেয় 'তুমি যেমন থাকো তেমন করে তোমায় কেউ পছন্দ না করলে সে অতিথিকে দ্বিতীয়বার ডেকোনা' এই সব মালকিনরা তাতে ঘ্যান ঘ্যান করে।
তারপর কে কার ওপর বেশি রাগ করে কাকপক্ষীতেও টের পায় না। কিন্তু ঘরে সুচিত্রার গান আর আমজাদের শরদের যুগলবন্দী বাজলে বোঝা যায় মান ভেঙেছে। এইসব ঘরগুলো গরমে খুব ঠান্ডা থাকে আর ঠান্ডায় ওম দেয়। ঘরের দেওয়ালের ডিস্টেমপার কালার হয় মাঝারি মানের কিন্তু স্নিগ্ধ, মেঝে হয় লাল রঙের। এই সব ঘরগুলোতে গাদা গাদা বই থাকে। তাতে রুপোলী লেজওয়ালা বইয়ের পোকা হলে নিমের পাতা গোঁজে মালকিন। রিটায়ারমেন্টের পর মালিক মালকিন মুখোমুখি বসে বই পড়ে পাকদন্ডী আর ইউলিসিস। এই সব বিলাসী ঘরের রকম মোটামুটি এমনই হয়।
একদিন সেই সব ঘরেরই একটা চেয়ার কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। ফুলদানি শূন্য পড়ে থাকে, ডিভানের চাদর কুঁচকে থাকে। জানলায় ঝোলে বাজারের মোটা পর্দা, দেওয়ালের ছবিগুলো ঈষৎ বেঁকে ঝুলতে থাকে। কুশন আর কাউকে মুড়ে ফাটিয়ে দিতে হয়না। কালের নিয়মেই মুড়ে যায়। সেন্টার টেবিলে পড়ে থাকে আধ খাওয়া জলের বোতল। মালকিন একবুক অভিমান নিয়ে বসে থাকে বিলাসের স্মৃতি মাখা সোফায় আর মালিক ছবি হয় ঝোলে। সুচিত্রা মিত্র আর আমজাদের যুগলবন্দীর ক্যাসেট আর বাজেনা। কবেই ফিঁতে জড়িয়ে গেছে।
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০.১০.১৯
No comments:
Post a Comment