Thursday, 7 November 2019

সে এক কাল ছিলো

#সে_এক_কাল_ছিল
আমার বাবার বাড়ি  এক্কেবারে গোঁড়া  ঘটি বাউন, আমার মা আমাদের  বাড়ির প্রথম রেজিস্টার্ড বাঙাল। তার আগে বাবার কাকামশাই স্বদেশী করতে গিয়ে বাঙাল মেয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে তাজ্য পুত্র হয়েছিলেন। এ হেন বাড়িতে বাঙালদের রান্না মানেই ছিল লাল লঙ্কার ঝালে ভরা তেল মশলা, পেঁয়াজ, রসুন দেওয়া গরগরে রান্না। যা খেলে সকাল বেলা বাহ্যে যেতে হয় বরপ নিয়ে, এমন কথা ও বাড়িতে হামেশাই শোনা যেত। 
আমাদের একটা খুব পুরনো পেল্লায়  বাড়ি ছিল। তাতে অনেক লোক। সেখানে তিন চার দফায় রান্না হত, জলখাবার, সেই সঙে বাড়ির ছেলেরা আপিস যাবে তাদের ভাত আর দুকুরবেলার রান্না। 
 তাতে আমার ছোটবেলাতেও  দেখেছি আমাদের যে হেঁশেল ছিল তাতে পরপর বাঁধান উনুন ছিল, (গ্যাস এসে যাবার পরেও), হেঁশেলের পাশেই ছিল খাবার দালান আর তার পাশে ভাঁড়ার ঘর। আমাদের জল আর বাটনা ব্রাহ্মণ বাড়ির লোক ছাড়া কেউ দিতে পারত না। শুনেছি আমার বড় জ্যাঠাইমা মাঝে মাঝেই আলাদা হয়ে গিয়ে ওই হেঁশেলেই রান্না করতেন। তার জন্য আমার বড় জেঠু  বালেশ্বর থেকে রান্নার বামুন নিয়ে আসতেন। কিছুদিন পর মিল হয়ে গেলে সে বামুন সবার রান্না করত। তারপর যে তার কি হত আমার স্পষ্ট মনে নেই। আসলে আজ থেকে বছর পঁচিশ সাতাশ বছর আগেও মফস্বল বা গাঁ গঞ্জের  অনেক ঘটি বাড়ির চেহারাই  উনিশ শতকের ঘটি বাড়ির চেয়ে খুব বেশি বদলায়নি। 
 আমাদের ওই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কুলদেবতা ছিলেন শ্রীধরদেব। আমরা হাফ বৈষ্ণব, কারণ বাড়িতে দুর্গা দালানে পুজোও হতো। কিন্ত আমাদের বাড়ি মাংস, ডিম পেঁয়াজ, রসুন হতো না। আমিষ পদ বলতে একমাত্র মাছ। সপ্তাহে একদিন পুকুর থেকে মাছ ধরা হতো আর বাকিদিন বাড়ির বাবুদের সঙ্গে কোনো কাজের মানুষ বাজার থেকে গিয়ে পেল্লায় পেল্লায় মাছ নিয়ে আসত। বাড়ির খিড়কির যে দরজা তাকে আমাদের বাড়িতে বলত গোরেলা। তা গোরেলার কাছে হাঁড়িতে সারা মাস রাখা থাকত জিওল মাছ। আমাদের ছোটদের জন্য রোজ আর বড়দের পেট খারাপ হলে সেই জিওল মাছ ছিল বরাদ্দ। আর ছিল রোজ রাতে খাবার শেষে দুধ ভাত। বাবা, জ্যাঠারাও খেতেন। মিষ্টি দুধ ভাতের সঙ্গে নোনতা আলুভাতের কম্বিনেশন।  আজও আমার বড় প্রিয়।
আমার মা গল্প করেন মা বিয়ের পর গিয়ে দেখেছেন রান্নাঘরের প্রধান ছিলেন বাবার জ্যাঠাইমা। আমরা বদ্দিদু বলে ডাকতাম। তা বদ্দিদু মাকে বিয়ের পর প্রথম ডেকে বলেছিলেন এই বাঙালের মেয়ে আমি রান্না করব বসে বসে শেখ। তোদের মত ঘাস পাতা এ বাড়িতে চলে না। তো প্রথম দিন মায়ের শিক্ষানবিশি শুরু হতে মা দেখেন বড় দিদু বিরাট লোহার কড়াইয়ে ডাল ফোটাচ্ছেন আর হড়হড় করে জল ঢালচ্ছেন, হঠাৎ  ডালের মধ্যে ঝপাস করে কি পড়ল। ডালের থেকে ছ ইঞ্চি ওপরে পাহাড়ের আকৃতির ভেলিগুড়ের ডেলা। মায়ের চোখের সামনে দুলতে দুলতে সেই ভেলিগুড়ের পাহাড় মিলিয়ে গেল আর মা মনেমনে ভাবছেন পায়েসেও এই পরিমাণ গুড় দেওয়া হয় কিনা সন্দেহ। মা মৃদু প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ধমক খেয়েছিল চুপ কর মাগী,  তোদের বাঙাল বাড়িতে নঙ্কা ছাড়া খেতে জানে নাকি। 
আমাদের বাড়ির পুরুষরা কেউ রুটি, মুড়ি খেতেন না। তাদের প্রতিদিনের জলখাবার ছিল অথবা কারও কারও রাতের খাবার ছিল নক্কি ঘিতে ভাজা নুচি। আমার সেজ জ্যাঠাইমা ছিলেন লুচি পরোটার এক্সপার্ট।  আমিও রুটি বেলতে শিখেছি জেঠিমার কাছে। জেঠিমাদের শেখান হয়েছিল নুচির নেচি হবে ছমাসের বাচ্ছার মুঠির মাপে, আর নুচি বেলতে হবে আড়াই প্যাঁচে।  তা সেই আড়াই প্যাঁচের লক্ষ্মী ঘিয়ের নুচির সঙ্গে থাকত  ক্ষীর। যে পুরুষের যত বেশি রোজকার আর যারা বয়ঃজ্যোষ্ঠ  তাদের ক্ষীর করার জন্য দুধের পো হত তত বেশি। 
আমাদের বাড়িতে বছরে মাঝে মাঝে কালীঘাট থেকে মাংস আসত। সেই মাংসের নিরামিষ ঝোল হতো। আমার মা এখনও মাঝে মাঝে হাজির দোকানের মাংসের নিরামিষ ঝোল করেন। তা কালীঘাটের সেই নিরামিষ মাংস আমাদের পাতে  পড়ত কণামাত্র। কিন্তু তাই আমরা সাপটে খেতুম।সে মাংসের দ্বায়িত্বেও থাকতেন বাবার জ্যাঠাইমা। আমার ছেলেবেলায় খুব অসুখ করেছিল একবার। ডাক্তাররা বাবা মাকে মুরগী খাওয়াতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এদিকে ও বাড়িতে মাংসই হয়না তার ওপর মুরগী।  অগত্যা বাবা চিকেন আম্পুল কিনে আনতেন। আর আমাকে বাড়ির বাইরে মেয়েদের স্নানেরঘাটে গিয়ে তা খাওয়ানো হতো। সেও এক পুকুরঘাটই ছিল বটে। ও বাড়িতে বৃহস্পতিবার ছিল নিরামিষ বাধা। সেদিন পোস্ত আর বিউলির ডাল মাস্ট। আমাদের বাড়িতে সবাই বলত কড়ায়ের ডাল। যেমন চাটনিকে বলত অম্বল, সুক্তোকে বলত শুক্তুনি, মাছের মাখা মাখা ঝোলকে গ্রেভি না বলে কাই বলত।
আমিষ হোক বা নিরামিষ মা বা বাড়ির অন্যান্য মায়ের জায়েদের রান্নার জোগানের কাজ ছিল। কিন্তু রান্না করতে হতো না। মায়ের বড় জা ছিলেন মায়েদের  কুড়ি বছরের বড়। তিনি আবার বিয়েতে যৌতুক হিসেবে  চুনা পাথরের টিলা পেয়েছিলেন আর মিশনারী স্কুলে ক্লাশ নাইন অদ্ধি পড়েছেন তাই জোগাড়ের কাজ করতে তিনি নারাজ। তার ওপরে সৎ শাশুড়ি তাঁর থেকে খুব বেশি বড় নন। কাজেই তোয়াক্কা খুব কাউকে করতেন না। আমার আবছা যেটুকু জ্যঠাইমার চেহারা মনে পড়ে তাতে চোখের সামনে পুরনো বাংলা সিনেমার রাজলক্ষ্মী দেবীর কথা মনে হয়। দিদি বলতে পারবে। ওর হয়ত জ্যাঠাইমাকে আর একটু ভালো মনে আছে। আমার বড় জেঠু ছিলেন খুব বড় টি টেস্টার। তাঁর কাছে প্রায়ই সাহেব সুবোরা আসতেন, তবে কলকাতার ফ্লাটে। একবার এক জার্মান সাহেব আর তার বউ আমাদের সিঙ্গুরের বাড়ি এলেন।  তারা আসবে বলে ভাল কাপ প্লেট, মিল্ক পট,সুগার পট, টিপট, টিকোজি বেরুলো। নিউ মার্কেট থেকে নানান খাবার এলো। জেঠিমা কয়েক ভরি গয়না পড়ে, পাতা কেটে চুল বেঁধে সাজলেন, ইংরিজিতে সাহেবদের ওয়েলকাম করবেন বলে। ও বাবা কোথায় কি, মেমসাহেব এসে যেই আমার বড়জেঠুকে হাগ করলে আর সেই  আমার বড় জ্যাঠাইমা স্ট্রাইক করে বসলেন। নিজে তো এলেনই না ছেলের বউদেরও আসতে দিলেন না। উপরন্তু সমস্ত নিউমার্কেট থেকে আনান খাবার দাবার দেরাজে পুরে চাবি দিয়ে দিলেন। অগত্যা বড় জ্যাঠামশাই মাম্মা মানে ঠাকুমার স্মরণাপন্ন হলেন। ঠাকুমা তাদের বেগুনি, কচুরি,  আলুরদম, আর শ্রীধরদেবের জন্য বাড়ির তৈরি মিষ্টি খাইয়ে মান বাঁচালেন জেঠুর। আর সার্ভ করার দ্বায়িত্ব পড়ল মায়ের। সাহেবরা নাকি দিব্যি চেটপুটে সব খেয়েছিলেন।
 যাই হোক ও বাড়ির রান্নায় ফিরি। মায়ের থেকে শুনেছি ডাল, ভাত, মাছ ছাড়া বাকি রান্নার দ্বায়িত্বে থাকতেন আমার ঠাকুমা। আমরা মাম্মা বলতাম ঠাকুমাকে। আমার ঠাকুমা ছিলেন মায়ের জেঠি শাশুড়ির একেবারে উল্টো।  অসম্ভব পার্সোনালিটি,  শিক্ষিত আর উদার। দারুন ভালো রান্না করতেন। যেমন ঘটি বাড়ির স্পেশালিটি শুক্তুনি, মোচা, আলুরদম, ধোঁকা, ছ্যাঁচড়া, কুমরোর ছক্কা রাঁধতেন তেমনি বাঙালদের কোনও রান্না থেকে সাহেবদের রান্না রপ্ত করে নিতেন ঠাকুমা ঝটপট। ঠাকুমার হাতের রান্না খেতে বাবার ইউনিভার্সিটির কলিগরা প্রায়ই চলে আসতেন আমাদের বাড়ি। এই সেদিনও একজনের সঙ্গে দ্যাখা হতে বলছিলেন সে কথা। 
এই গোঁড়া ঘটি বাড়িতে আমার মায়ের হাত ধরে ধিরে ধিরে বাঙাল রান্না ঢুকছিল সবার অজান্তে। আসলে মায়ের ধীর শান্ত স্বভাবের জন্য মায়ের ওই ঘটি বাড়ির সমস্ত সদস্যদের কাছে মায়ের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আর মায়ের সঙ্গে একই সময় বিয়ে হয়ে এসেছিল মায়ের খুড়তুতো জা আর আমার বড় জ্যাঠার বড় ছেলের বউ, আর তার কিছুদিন পর ছোটছেলের বউ। আর মার থেকে পাঁচ সাত বছরের বড় আমার সেজ জেঠিমা। বেশ পরে আমার ছোটকাকু বাঙাল বিয়ে করে ছিলেন। যাই হোক মায়ের জায়েরা  কেন যেন মাকে খুব ভালোবাসতেন।  ঠাকুমাদের পর মায়েদের হাতে যখন রান্নার ব্যাটন এলো তখন থেকে এ বাড়িতে কচুর লতি, কচুর শাক, থারকোন পাতা বাটা এসব ইন্ট্রডিউসড হতে শুরু করল। মা চাকরি করতেন তাই রবিবারের সমস্ত স্পেশাল রান্না ছিল মায়ের। এখনও আমার সাতাশি বছরের সেজ জেঠুর বাঙাল বৌমার হাতের রান্না ছাড়া মুখে রোচে না।
কিন্তু ওই বাড়িতে আমাদের ছোটদের ছিল ভারি দুঃখ। বন্ধুরা ইশকুলে এসে কেমন মাংস পেঁয়াজের গল্প করত আমাদের সে উপায় ছিল না। তাই হাঁ করে থাকতাম ছুটিতে মামাবাড়ি যাবার জন্য। ওখানে গেলেই দেদার মাংস আর কাঁচা পেঁয়াজ। আমার মামাবাড়ির প্রত্যেকের ছিল অসম্ভব ভালো রান্নার হাত। মাও জেনেটিকালি সেটা পেয়েছেন। দিদিও কিছুটা। আমারটা এখনও পরীক্ষিত নয়। রেয়ারলি করলে লোকে মন্দ বলে না ওই অব্দি। একদিন মামাবাড়ির রান্নার গল্প করব।
আমাদের ছেলেবেলার আর একটা কথা দিয়ে শেষ করি। আমাদের খামারে ধান ঝাড়া হতো।  সেখানে মুনিষরা দুপুরবেলা খেতে বসত আলু পেঁয়াজের তরকারি আর ভাত। একটুখানি তরকারি দিয়ে সাপটে ভাত মেখে খেত। আমি আর আমার খুড়তুতো দুই দিদি প্রায়ই দুপুরবেলা ওদের খাবার সময় হাঁ করে খামারে বসে থাকতুম, যদি দেয়। সাহস করে দেয়নি কখনো। কেবল একবার একজন একটা ডিমকে সুতো দিয়ে চার টুকরো করে নিজের জন্য একটুকরো রেখে আমাদের বাকিটা দিয়েছিল। সে ডিমের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। আমার কৈশরেই আমাদের যৌথ বাড়ি টুকরো হয়ে গেছিল। বাবাদের আগের প্রজন্ম একেএকে চলে গেলেন। মাংস, পেঁয়াজ, ডিম খাওয়া যায় না ইত্যাদি অজুহাত দিয়ে সকলে ওই বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি করে উঠে গেলো। তিনমহলা ওই বাড়িখানায় আমার এক খুড়তুতো কাকু একা পড়ে আছেন। আমরা দু বোন, বাবা, মা আর সেজো জেঠু জেঠিমা একখানা বাড়ি করে উঠে গেলাম। সে বাড়িতেও খাওয়ার ঘটা ছিল খুব। এখন নতুন বাড়িতেও কেউ নেই। বাবা, জেঠিমা চলে গেছেন। আমরা দু বোন বিয়ে হয়ে দুদেশে। কেবল বাড়িটার দু প্রান্তে পড়ে আছেন আমার মা আর সাতাশি বছরের জেঠু। কিন্তু ঘটি বাড়ির খাওয়াত রীতিটি তিনি আজও বজায় রেখেছেন। দেড় লিটার দুধ, ছটা তরকারি, দুটো রসগোল্লা ইত্যাদি তাঁর রোজ চাই। থাকুক ওই টুকু অন্তত থাকুক। 
সামনেই জন্মাষ্টমী। আমি এ লেখা লিখতে লিখতে আমাদের পুরনো বাড়ির দুর্গা দালানে পাত পেতে বসে খাওয়ার দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। নাকে আসছে গাওয়া ঘিয়ের নুচি আর তালের বড়ার গন্ধ। কি জানি এতো ব্যক্তিগত গন্ধ আপনাদের নাকে পৌঁছবে কিনা। জানি না এত ব্যক্তিগত খাওয়ার গল্পে   আপনারা বিরক্ত হলেন কিনা।
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment