আমার পুজোর সেকাল
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।
আমার কলকাতার পাড়ায় এই দ্বিতীয়ার দিনই পুজো উদ্বোধনে দেব, আলো জ্বলছে, হোর্ডিং তো পড়ে গেছে সেই কবেই, মাইকিং হচ্ছে, বস্ত্র দানের লাইন, দেবকে দেখার ভিড়, এসবের মধ্যে আমার মনে পড়ছিল দ্বিতীয়া,তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমীর সিঙ্গুরকে। পঞ্চমী অব্দি আমাদের ছিল পুজো আসছে আসছে ভাব, আর ষষ্টির দিন মনে হত এই তো সবে পুজো এলো।
তখন সিঙ্গুরকে কেই বা তেমন চিনত! টাটা হবার পর যে সিঙ্গুরকে মানুষ চিনল সেখানে টোকা মাথায় কিছু মানুষ, যাদের একদল কারখানা চায় আর একদল জমি চায়, অনাহার, অশিক্ষা, তাপসী মালিক। সত্যি কি তেমন ছিল আমাদের সিঙ্গুর! যারা শীর্ষেন্দুর গল্পে গঞ্জগুলোর বর্ণনা পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন কেমন ছিল আমার দেশ। হপ্তায় দু দিন হাট বসত, গোটা তারকেশ্বর লাইনের ট্রেড সেন্টার ছিল এই সিঙ্গুর, পুজোর আগে ভেতরের গাঁ থেকে হাটে কুলো ধামার সঙ্গে শাড়ি জামা কিনে হেঁটে, সাইকেলে, ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরত লোকে, আর সিঙ্গুরের পয়সাওলা বাবু বাড়ির লোকেরা জামা কিনত বাজারের পাকা দোকান থেকে। তখনো রূপশ্রীর মতো দু-এক খানা দোকান ছাড়া গদিতে বসিয়ে গস্ত করাই ছিল দস্তুর। দালান কোঠাওলা মস্ত মস্ত বাড়িতে সাবেকি পুজো হত,( এককালে আমাদের নিজেদের জলাঘাটার বাড়িতেই তাই হত, যা আজ ঠেকেছে ঘটপুজোয়।)। পাশাপাশি বাস করা বামুন মাহিষ্য নির্দ্বিধায় অংশ নিতেন সে পুজোয়, শ্রেণি বিভাজন ছিল না তেমন নয় তবে সে সম্পর্কে তেমন বিদ্বেষ আর সচেতনতা কোনটাই ছিল না। আরো আগের কথা জানি না, আমার ছেলেবেলায় চাষি পরিবারগুলিতে লক্ষ্মী, সরস্বতী বাঁধা পড়ছিল দুরন্ত গতিতে। তাই বামুন, মাহিষ্যের ভেদাভেদ তলানি ঠেকত পুজোর দিনগুলোতে। আর তখনো বামুন, ক্ষত্রিয় এমনকি কিছু মাহিষ্য (সিঙ্গুরে বড় সংখ্যক ক্ষত্রিয় আর ছেত্রী পরিবার আছে) বাড়িগুলোতে ধানের গোলা যেমন ছিল,তেমনি বিলেত আমেরিকা ঘোরা, ডাক্তার, অফিসার, প্রফেসার, ইঞ্জিনিয়র বাবুদের সংখাও ছিল বেশ। ছিল একশ দেড়শ বছরের পুরনো গার্লস, বয়েজ ইস্কুল, সিঙ্গুর ঘিরে তিন তিনটে রেলওয়ে স্টেশন।এমনকি আমার ছেলেবেলাতে সিঙ্গুরের বুক চিরে দুর্গাপুর রোডও দেখেছি, এসব যেমন ছিল তেমন ছিল পোটো পাড়ার শঙ্কর পোটোর দিঘল চোখের মেঠো দুগগা আর রাধা গোবিন্দ সাহার শিক্ষিত হাতের আর্টিস্টিক প্রতিমা। কেবল ছিল না সিঙ্গুরকে হাস্যকর করার জন্য, করুণার যোগ্য করে তোলার জন্য মিডিয়ার ওবি ভ্যানগুলো, ছিল না বাংলা স্টেটসম্যান, গণশক্তি আর আনন্দবাজারের রিপোর্টিং।
যাক সে সব অন্যকথা, অন্য প্রসঙ্গ। এই দ্বিতীয়ায় আমার অন্তকৈশরের, আমার প্রারম্ভ যৌবনের সিঙ্গুরকে মনে পড়ছিল খুব। (যদিও তখন খুব কাছেই ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছিল টাটা আর তাকে ঘিরে আন্দোলন)।দ্বিতীয়ার দিন কলেজ থেকে সিঙ্গুর স্টেশনে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরতুম, তখন পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা ছিল বটে তবে তেমন জোরাল স্ট্রিট লাইট ছিল না, ফলে ইস্কুল মোড়ের দোকান গুলো পেরোলেই গোটা রাস্তা জুড়ে থাকত আলো অন্ধকার। তার মধ্যে দেখতুম শতাব্দী প্রাচীন সিঙ্গুর ক্লাবে ইলেক্ট্রিক হ্যালোজেন জ্বালিয়ে ত্রিপল পড়ছে বাঁশে। ফটক পেরিয়ে সাতমন্দির তলায় এলেই চোখে পড়ত ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সাতটি শিবের মন্দির। সাতমন্দিরের কাছে এলেই নাকে ঝাঁপিয়ে পড়ত হাসনুহানার গন্ধ, ও গন্ধটা সারা বছর জড়িয়ে থাকত মন্দির তলায়। তারপর রায় চোধুরী আর বর্মনদের বাড়ি ডান হাতে রেখে এগুলেই পড়ত রাজহাঁসওলা মাটির বাড়িখানা, সেখান থেকে শুরু করে কোথা কোথা দিয়ে যে শিউলির গন্ধ নাকে আসত জানি না। এরপর বাঁ হাতের দুটো গলি পেরুলেই আমার বাড়ির গলি, এই এত্তখানি রাস্তায় একখানাও পুজো চোখে পড়ত না। কেবল রাস্তায় পাড়ার কাকু দাদাদের সঙ্গে দ্যাখা হলে বলত দ্যাখ গিয়ে বাঁশ বাঁধা কমপ্লিট আজ রাত থেকে ত্রিপল পড়বে,কাল থেকে কাপড় বাঁধা। গলির মুখে ওই বাঁশের স্ট্রাকচারটুকু দ্যাখার জন্য হাঁটাত গতি বাড়িয়ে দিতুম কয়েশগুন। তখন আমাদের নবাসনের পুজোছিল রীতিমত জাঁকের পুজো, ওদিকে বিদ্যুতপল্লি, এদিকে অপূর্বপুর আর জলাঘাটার পুজোর মাঝখানের সমস্ত লোকের ছিল দ্বিতীয়ার দিন বাঁশ বাঁধা আমাদের নবাসনের পুজো। সে এলাকা নেহাৎ কম বড় নয়। আমরা ছিলুম ও প্যান্ডেলের গায়ের গলির লোক তাই মনে একটু গর্ব গর্ব ছিল, ছিল কিঞ্চিৎ দিদিগিরিও। দ্বিতীয়ার বাঁশ বাঁধা থেকে ষষ্টির দিনের সম্পূর্ণ প্যান্ডেল দ্যাখায় ছিল শাজাহানের তাজমহল তৈরি দেখার আনন্দ, সে উত্তেজনার কথা আমার চেয়ে বড় বা আমার সমসাময়িক অনেকেরই মনে আছে নিশ্চই।
কতবছর চাকরী, নানা ঝড় ঝাপ্টা, বাবার চলে যাওয়া, বাড়িতে থেকেও পুজো না দেখার আলিস্যি,পুজোর ভিড়ে বাংলার বাইরে থাকার উন্নাসিকতা, কলকাতার সংসার, এসব মিলিয়ে সিঙ্গুরের পুজো দ্যাখা হয়নি। চতুর্থীর দিন পড়ি কি মরি করে ছুটলাম সিঙ্গুরের পুজো দেখতে। কিন্তু একি চতুুর্থীর সিঙ্গুরের রূপ! না দেবের উদ্বোধন হয়ত হয়নি, কিন্তু রাস্তা জুড়ে ঝলমলে আলো, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, প্রসাধনীর দোকানে লাইন, ত্রি কোয়াটার জিন্স আর টপ গায়ে ট্রুলি গ্লোবাল ছেলে মেয়ে, মোমোর দোকান,ফ্লাটবাড়ি থেকে ঝুলতে থাকা আলো, অনলাইন শপিং-এর স্কুটার। এই আমার সিঙ্গুরের চতুর্থী! আমি সিঙ্গুরে আসিনা তা তো না, আমার তো আন্দাজ করা উচিৎ ছিল বদলে যাওয়া চতুর্থীর...
ক্রমশ...
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।
আমার কলকাতার পাড়ায় এই দ্বিতীয়ার দিনই পুজো উদ্বোধনে দেব, আলো জ্বলছে, হোর্ডিং তো পড়ে গেছে সেই কবেই, মাইকিং হচ্ছে, বস্ত্র দানের লাইন, দেবকে দেখার ভিড়, এসবের মধ্যে আমার মনে পড়ছিল দ্বিতীয়া,তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমীর সিঙ্গুরকে। পঞ্চমী অব্দি আমাদের ছিল পুজো আসছে আসছে ভাব, আর ষষ্টির দিন মনে হত এই তো সবে পুজো এলো।
তখন সিঙ্গুরকে কেই বা তেমন চিনত! টাটা হবার পর যে সিঙ্গুরকে মানুষ চিনল সেখানে টোকা মাথায় কিছু মানুষ, যাদের একদল কারখানা চায় আর একদল জমি চায়, অনাহার, অশিক্ষা, তাপসী মালিক। সত্যি কি তেমন ছিল আমাদের সিঙ্গুর! যারা শীর্ষেন্দুর গল্পে গঞ্জগুলোর বর্ণনা পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন কেমন ছিল আমার দেশ। হপ্তায় দু দিন হাট বসত, গোটা তারকেশ্বর লাইনের ট্রেড সেন্টার ছিল এই সিঙ্গুর, পুজোর আগে ভেতরের গাঁ থেকে হাটে কুলো ধামার সঙ্গে শাড়ি জামা কিনে হেঁটে, সাইকেলে, ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরত লোকে, আর সিঙ্গুরের পয়সাওলা বাবু বাড়ির লোকেরা জামা কিনত বাজারের পাকা দোকান থেকে। তখনো রূপশ্রীর মতো দু-এক খানা দোকান ছাড়া গদিতে বসিয়ে গস্ত করাই ছিল দস্তুর। দালান কোঠাওলা মস্ত মস্ত বাড়িতে সাবেকি পুজো হত,( এককালে আমাদের নিজেদের জলাঘাটার বাড়িতেই তাই হত, যা আজ ঠেকেছে ঘটপুজোয়।)। পাশাপাশি বাস করা বামুন মাহিষ্য নির্দ্বিধায় অংশ নিতেন সে পুজোয়, শ্রেণি বিভাজন ছিল না তেমন নয় তবে সে সম্পর্কে তেমন বিদ্বেষ আর সচেতনতা কোনটাই ছিল না। আরো আগের কথা জানি না, আমার ছেলেবেলায় চাষি পরিবারগুলিতে লক্ষ্মী, সরস্বতী বাঁধা পড়ছিল দুরন্ত গতিতে। তাই বামুন, মাহিষ্যের ভেদাভেদ তলানি ঠেকত পুজোর দিনগুলোতে। আর তখনো বামুন, ক্ষত্রিয় এমনকি কিছু মাহিষ্য (সিঙ্গুরে বড় সংখ্যক ক্ষত্রিয় আর ছেত্রী পরিবার আছে) বাড়িগুলোতে ধানের গোলা যেমন ছিল,তেমনি বিলেত আমেরিকা ঘোরা, ডাক্তার, অফিসার, প্রফেসার, ইঞ্জিনিয়র বাবুদের সংখাও ছিল বেশ। ছিল একশ দেড়শ বছরের পুরনো গার্লস, বয়েজ ইস্কুল, সিঙ্গুর ঘিরে তিন তিনটে রেলওয়ে স্টেশন।এমনকি আমার ছেলেবেলাতে সিঙ্গুরের বুক চিরে দুর্গাপুর রোডও দেখেছি, এসব যেমন ছিল তেমন ছিল পোটো পাড়ার শঙ্কর পোটোর দিঘল চোখের মেঠো দুগগা আর রাধা গোবিন্দ সাহার শিক্ষিত হাতের আর্টিস্টিক প্রতিমা। কেবল ছিল না সিঙ্গুরকে হাস্যকর করার জন্য, করুণার যোগ্য করে তোলার জন্য মিডিয়ার ওবি ভ্যানগুলো, ছিল না বাংলা স্টেটসম্যান, গণশক্তি আর আনন্দবাজারের রিপোর্টিং।
যাক সে সব অন্যকথা, অন্য প্রসঙ্গ। এই দ্বিতীয়ায় আমার অন্তকৈশরের, আমার প্রারম্ভ যৌবনের সিঙ্গুরকে মনে পড়ছিল খুব। (যদিও তখন খুব কাছেই ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছিল টাটা আর তাকে ঘিরে আন্দোলন)।দ্বিতীয়ার দিন কলেজ থেকে সিঙ্গুর স্টেশনে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরতুম, তখন পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা ছিল বটে তবে তেমন জোরাল স্ট্রিট লাইট ছিল না, ফলে ইস্কুল মোড়ের দোকান গুলো পেরোলেই গোটা রাস্তা জুড়ে থাকত আলো অন্ধকার। তার মধ্যে দেখতুম শতাব্দী প্রাচীন সিঙ্গুর ক্লাবে ইলেক্ট্রিক হ্যালোজেন জ্বালিয়ে ত্রিপল পড়ছে বাঁশে। ফটক পেরিয়ে সাতমন্দির তলায় এলেই চোখে পড়ত ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সাতটি শিবের মন্দির। সাতমন্দিরের কাছে এলেই নাকে ঝাঁপিয়ে পড়ত হাসনুহানার গন্ধ, ও গন্ধটা সারা বছর জড়িয়ে থাকত মন্দির তলায়। তারপর রায় চোধুরী আর বর্মনদের বাড়ি ডান হাতে রেখে এগুলেই পড়ত রাজহাঁসওলা মাটির বাড়িখানা, সেখান থেকে শুরু করে কোথা কোথা দিয়ে যে শিউলির গন্ধ নাকে আসত জানি না। এরপর বাঁ হাতের দুটো গলি পেরুলেই আমার বাড়ির গলি, এই এত্তখানি রাস্তায় একখানাও পুজো চোখে পড়ত না। কেবল রাস্তায় পাড়ার কাকু দাদাদের সঙ্গে দ্যাখা হলে বলত দ্যাখ গিয়ে বাঁশ বাঁধা কমপ্লিট আজ রাত থেকে ত্রিপল পড়বে,কাল থেকে কাপড় বাঁধা। গলির মুখে ওই বাঁশের স্ট্রাকচারটুকু দ্যাখার জন্য হাঁটাত গতি বাড়িয়ে দিতুম কয়েশগুন। তখন আমাদের নবাসনের পুজোছিল রীতিমত জাঁকের পুজো, ওদিকে বিদ্যুতপল্লি, এদিকে অপূর্বপুর আর জলাঘাটার পুজোর মাঝখানের সমস্ত লোকের ছিল দ্বিতীয়ার দিন বাঁশ বাঁধা আমাদের নবাসনের পুজো। সে এলাকা নেহাৎ কম বড় নয়। আমরা ছিলুম ও প্যান্ডেলের গায়ের গলির লোক তাই মনে একটু গর্ব গর্ব ছিল, ছিল কিঞ্চিৎ দিদিগিরিও। দ্বিতীয়ার বাঁশ বাঁধা থেকে ষষ্টির দিনের সম্পূর্ণ প্যান্ডেল দ্যাখায় ছিল শাজাহানের তাজমহল তৈরি দেখার আনন্দ, সে উত্তেজনার কথা আমার চেয়ে বড় বা আমার সমসাময়িক অনেকেরই মনে আছে নিশ্চই।
কতবছর চাকরী, নানা ঝড় ঝাপ্টা, বাবার চলে যাওয়া, বাড়িতে থেকেও পুজো না দেখার আলিস্যি,পুজোর ভিড়ে বাংলার বাইরে থাকার উন্নাসিকতা, কলকাতার সংসার, এসব মিলিয়ে সিঙ্গুরের পুজো দ্যাখা হয়নি। চতুর্থীর দিন পড়ি কি মরি করে ছুটলাম সিঙ্গুরের পুজো দেখতে। কিন্তু একি চতুুর্থীর সিঙ্গুরের রূপ! না দেবের উদ্বোধন হয়ত হয়নি, কিন্তু রাস্তা জুড়ে ঝলমলে আলো, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, প্রসাধনীর দোকানে লাইন, ত্রি কোয়াটার জিন্স আর টপ গায়ে ট্রুলি গ্লোবাল ছেলে মেয়ে, মোমোর দোকান,ফ্লাটবাড়ি থেকে ঝুলতে থাকা আলো, অনলাইন শপিং-এর স্কুটার। এই আমার সিঙ্গুরের চতুর্থী! আমি সিঙ্গুরে আসিনা তা তো না, আমার তো আন্দাজ করা উচিৎ ছিল বদলে যাওয়া চতুর্থীর...
ক্রমশ...
No comments:
Post a Comment