#যাতে_প্রতিবাদ_ভালো_হয়
যাঁরা ভাবছেন প্রতিবাদ করে পরিবর্তন আনবেন তাঁরা এই সমস্ত ডিপ্রেশনের দিনে ঘরে বসে না থেকে বেরিয়ে পড়ুন। অবশ্যই আপনার বাড়ির গাড়িতে নয়। পায়ে হেঁটে অথবা বাসে, ট্রেনে, মেট্রোতে। ধরুন আপনি হাজরা মোড়ে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন বাসের আশায় দেখবেন আপনার পাশের লোকটি প্যান্ট খানিক গুটিয়ে, বাঁ বগলে ফাইল নিয়ে, বাঁ হাতে একটা শিক বের করা ছাতা নিয়ে, ডান হাতে সদ্য নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ঠোঙায় বাজার নিয়ে, কাঁধ দিয়ে কানে ফোন চেপে উচ্চগ্রামে গিন্নির কাছে আবদার করছে খিচুড়ি খাবার, সে জন্য সে মাস শেষে চড়া দামে অসময়ের ফুলকপি কিনে নিয়ে যাচ্ছে এ কথাও আপনি শুনতে পাবেন। বিকট চিৎকার আর ঘরের কথা পাবলিকলি বলা আপনার যতই আনসিভিলাইসড মনে হোক এমন এসব ডিপ্রেশনের দিনে এক হাত অন্তর এসব ঘটেই থাকে। অথবা যে ব্রান্ডেড ভুজিয়াওয়ালার থেকে আপনার ড্রিংসের চাট আসে তার দোকানের নিচে দেখবেন সাতখানা প্লাস্টিকের চিরুনি, আর কয়েকটা প্লাস্টিকের আয়না নিয়ে মাটিতে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। কোমর থেকে সপসপে ভিজে ওই বৃদ্ধের চুলে কিন্তু চিরুনি পড়েনি আজ। আর বৃদ্ধের না বিক্রি হওয়া প্লাস্টিকের আয়নায় জলের ছিটে আর চলমান জীবনের ছবি দেখতে পাবেন একটু উঁকি মারলেই। দেখবেন রোজকার চা ওয়ালা বৌদি ভিজে সপসপে মানুষগুলোকে চা দেবে বলে ডেচকি থেকে মগের ওপরে রাখা ন্যাকড়াতে চা ঢালছে আঁচল দিয়ে ধরে। সরে যাওয়া আঁচলের ফাঁক দিয়ে তাঁর একখানা হুক খুলে যাওয়া বুকের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে কেউ কেউ তাকিয়ে আছে জেনেও, যতক্ষণ না চা ঢালা হয় আঁচল টানার উপায় নেই তাঁর। দেখবেন রাধা গোবিন্দর মন্দিরের সামনে ফুলওয়ালারা ফুলে প্লাস্টিক চাপা দিয়ে, হাতে এক গোছা গোলাপ নিয়ে বিষন্ন মুখে বসে আছে। যদি কোনও প্রেমিক এই ভরা বৃষ্টির দিনে একথোকা গোলাপ নিয়ে যায় সেই আশায়। আর রজনীগন্ধার স্টিকগুলো দেওয়াল ধরে মাথা উঁচু করে দাঁডিয়ে আছে। কত দূরেই বা ক্যাওড়াতলা শ্মশান, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল থেকে যারা লাস হয়ে বেরোয় তাদের ডিপ্রেশনেও রজনীগন্ধা লাগে। আর দেখবেন ফুলওয়ালার ডাঁটি ভাঙা চশমার কাচ জলের ছিটে লেগে কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। এইবারে বাসে ওঠার পালা। যথারীতি আজ আপনি জায়গা পাবেন না। উঠে আপনাকে বলতেই হবে দাদা একটু পেছন দিকে এগোন না। পেছনটা খালি আছে। আমরা ঝুলছি। তারপর কোনও রকমে ডজ মেরে গিয়ে একটা রড ধরে সেট হয়ে যান। মাঝে মাঝে বলতে থাকুন দাদা ছাতা সামলে, প্লাস্টিকের প্যাকেট আনতে পারেন না বাড়ি থেকে আপনার ছাতার জলে ভিজে গেলুম ইত্যাদি। এসবের মাঝেই যারা সিটে বসে আছেন তাঁদের প্রচন্ড ঈর্ষা করতে করতে ওঁদের গল্পেই মশগুল হয়ে যান। দেখবেন NRC থেকে বিক্রম, ডি. এ বাড়া না বাড়া থেকে হিন্দি আগ্রাসন, মমতা, মোদী আর সিপিএম কে বেশি খারাপ নিয়ে মতান্তর অথবা মতানৈক্য, বাঙালি জাতির ধ্বংসের সম্ভবনা এসব নিয়ে তুমুল আড্ডা চলছে। একজনের পায়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোও তাতে মিশে যাচ্ছে দিব্য। কারও কারও কণ্ডাক্টর সঙ্গে একটাকা বেশি ভাড়া নিয়ে তুমুল তর্ক হচ্ছে। তাতে সমবেত ভাবে বহু স্বর শোনা যাচ্ছে রোজ রোজ এই এক টাকার চালাকি আর চলবে না বলে। তার মাঝেই কেউ বলছে তার মেয়েও ভালো গান গায় কিন্তু রানুদির মত কপাল নয়। দেখবেন এদের সমস্ত গল্পের মাঝখানে কেমন কান্না মিশে থাকে। এমন কি হাসিতেও। এসব সামলে ধীরে ধীরে আপনার বাড়ির স্টপেজে নেমে যান। তারপর আপনার তেইশ তলার ফ্লাটে লিভিং এরিয়ায় বসে চিন্তা করুন কাল ফেসবুকে অথবা কোনও এসি সভাকক্ষে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় যাদবপুরের পক্ষে থাকবেন না বাবুল সুপ্রিয়, নাকি কাউকেই না চটিয়ে ট্রাম্পে চলে যাবেন সোজা। সঙ্গে হালকা সিম্ফোনি, কাঁচের গেলাসে দামি হুইস্কি আর আর আপনার টেরেস গার্ডেনের ট্যোমাটো স্যালাদ মাস্ট। তাতে বিপ্লব ভালো হয়।
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়
২৫.০৯.১৯
No comments:
Post a Comment