Thursday, 7 November 2019

শিক্ষক দিবস

#শিক্ষক_দিবস
খুব মনে আছে একবার ক্লাসে একটি মেয়ে শতাব্দী দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করেছিল শিক্ষক দিবস কেন পালন করতে হয়। কি সুন্দর করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দিদি। দিদির কথা আমরা এমনিই মন দিয়ে, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, সেদিন থেকে মন কেড়ে  নিয়ছিলেন দিদি আমাদের। সেদিন ওই ছিল আমাদের শিক্ষক দিবস পালন। কোনও আড়ম্বর ছিল না। কেক কাটা ছিল না, দিদিদের দামী গিফট দিতে হত না। বড় জোর বোর্ডে এক লাইন লিখে ফুল সাজিয়ে অপেক্ষা করতে হত দিদিমণি, মাস্টার মশাইদের জন্য। তারপর তাঁদের নিজেদের মত করে,শ্রদ্ধা জানানো। 
আমাদের সময় দিদিমণিরা ছিলেন বড় সাদা মাটা সাজের। সাদা কাপড় আর হাত খোঁপা আর পরিস্কার করে ভাঁজ করে পরা শাড়ি। এই সামান্য সাজেই কি অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ছিল ওঁদের। বীথি দি কিই বা করতেন ওই সময় সাজ গোজ কিচ্ছু না, কিন্তু ওঁর জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, গানের গলা, স্নেহ  সব মিলিয়ে মনে হত বড় হলে এমনটাই হবো। যিনি বা যাঁরা আজও আমাদের আইডলমনে মনে পড়ে দীপিকা দির অনবদ্য ইংরিজি ক্লাস।ছায়া দির পড়ানো,  ছায়া দি বা ছানু দি আঙুল কেটে গেছিলো বলে টিফিন বক্স খুলে খাইয়ে দিয়েছিলেন আমায়।  এসব লিখতে গিয়ে চোখের কোল অজান্তেই ভিজে উঠছে আমার। কার কথা ছেড়ে কার কথা বলি,  মাধুরী দি,পূরবী দি, দুই শ্যামলী দি, দুই কবিতা দি, দুই অনুরাধা দি, অনিতা দি,কাবেরী দি, অকালে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া মিষ্টি, শান্ত  কণিকা দি, শান্ত, সৌম্য অল্প বয়েসের হেনা দি, পুস্পিতা দি, রেবা দি, দুই গৌরী দি, কল্যাণী দি, পুতুল দি, রমা দি, নীলিমা দি অথবা স্কুলের ৪২ জন শিক্ষককে দেখেই মনে হতো এর চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা কি কাউকে করা যায় এ জীবনে! আমার ক্লাস ফোর পর্যন্ত যাঁরা পড়িওয়েছেন, বড় আন্টি, ফাল্গুনী আন্টি আজও আমার মণিকোঠায়।আর যাদের কথা আজ বলতেই হয় সবিতা দি আমার প্রথম টিচার শর্মিলা দি আমার প্রথম অঙ্কের  দিদিমণি। আমাদের ইলেভেন টুয়েলভ ছিল কো এডুকেশন, কি জানি মেয়েদের স্কুল থেকে প্রথম আড় ভেঙে ছেলেদের সহজ বন্ধু হতে শিক্ষকরা সাহায্য না করলে আজও আমাদের অটুট বন্ধুত্ব থাকত কিনা। কার নাম বলব আমাদের ইলেভেন, টুয়েলভে শিক্ষকদের বা স্কুল জীবনের শিক্ষকদের অথবা আমার জীবন পাঠের শিক্ষদের, এই ডিজিটাল খাতাও কম মনে হয়।  আলাদা করে  সত্যি বলছি সিঙ্গুরের মত জায়গায় অমন সব দক্ষ চমৎকার শিক্ষরা ছিলেন বলেই আমাদের দুটো স্কুল থেকে এতো কৃতি ছাত্র ছাত্রী বেরিয়েছে। মিডিয়াতে দ্যাখানো যে সিঙ্গুর, তার মতো যে সিঙ্গুরের চেহারা আদৌ নয়,  এখানে লেখা- পড়ার হার অত্যন্ত বেশি, আপনাদের নিরিখে যাঁরা এ জীবনে সবচেয়ে সফল সেই ডাক্তার এঞ্জিনিয়র সিঙ্গুরের ঘরে ঘরে তার জন্য এই সমস্ত শিক্ষদের অবদান যে অনেকখানি। নাহলে এক জেনারেশন আগে বাবা চাষ করতেন ছেলে ইসরো বা আই আই টি তে, অথবা এম ডি, ডি এম ডাক্তার  এ চিত্র সিঙ্গুরে মোটেই  বিরল নয়। তাঁরা শিক্ষকদের অবদান নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না আমি জানি। আমি স্কুলে দিদিমণি, মাস্টারমশাইদের যে ভালোবাসা পেয়েছি তা ভাবলে আজও অবাক হই।
স্কুলের পরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথম সেলিব্রিটি শিক্ষকদের দ্যাখা পেয়েছিলুম। কি জানি আমার সৌভাগ্য কিনা প্রায় সকলেই আমাকে স্কুলের মতই অত্যন্ত ভালোবেসেছেন সেই জন্যি বোধহয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতায় মন্দের স্মৃতি তেমন নেই। পরবর্তী জীবনে আমি যে সমস্ত মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি তাঁরা নিজেরাই একেকটা ইন্সটিটিউশন। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অশোক মুখোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, দত্তাত্রেয় দত্ত,  সুমন চট্ট্যোপাধ্যায় আমার ছাত্র জীবনে এবং কর্ম জীবনে পাওয়া এমন বহু নাম। জানি এমন বহু শিক্ষকের নাম দিলুম না যাঁদের কাছে এ জীবনে ঋণের ভারে আমি নুইয়ে থাকব। 
আর আমার বাবা, মা দুজনেই পেশাগত ভাবে শিক্ষক ছিলেন। মা,স্কুলে পড়াতেন বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে।  আজও  বাবা মার ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে দ্যাখা হলে তাঁদের প্রতি যে সম্মান শ্রদ্ধা দেখি আমার গর্ব হয় যে আমি শিক্ষকের সন্তান। আর বাবা হয়ত আত্মমগ্ন থাকতেন, ডুবে থাকতেন লেখাপড়ায়, তাই সত্যি বাবার কাছে স্কুল-কলেজের পড়া পড়িনি কখনও।  মনে হতো ওরে বাবা এতো নিচু ক্লাসে বাবা কি পড়াবেন।  কিন্তু পরবর্তী জীবনে তাঁর সঙ্গে আড্ডায় যা পড়েছি তা আমার সারা জীবনের পাথেয়। মা পড়িয়েছেন অনেক। মায়ের সব পড়ানো ছেড়ে একটা কথা আজো মনে পড়ে কোনও শিক্ষকের কিছু ভুলের কথা মাকে বলে ছিলাম একদিন। উত্তরে মা বলেছিলেন শিক্ষকের ত্রুটি ধরো না কখনও।  মনে রেখো উনি তোমার চেয়ে, শ্রেষ্ঠ অনেক বেশি জানেন বলেই উনি শিক্ষক আর তুমি ছাত্র। সেই শিক্ষা আমাদের দু বোনেরই আজও পাথেয়। একই কথা আমি দিদিকে ওঁর মেয়েকে বলতে শুনেছি। আর তিন জনের কথা না বললেই নয়। আমার মেজ মামা অঙ্কের মানুষ কিন্তু উনি হলেন জীবন্ত এনসাক্লোপিডিয়া আর আদর্শ শিক্ষক। যাঁর শিক্ষক জীবন নিয়ে আস্ত উপন্যাস হওয়া সম্ভব।  মায়ের বন্ধু সুনীতি দাস   আমাদের বড়মাসি যাঁর মতো শিক্ষাকে সাধনা করতে এ জীবনে খুব কম মানুষকে দেখেছি। প্রকৃত নির্লিপ্তির উদাহরণ আমার কাছে বাবা, ফুল মামা আর বড় মাসি। আমি যে আবেগে বাড়িয়ে বলছি না যাঁরা এদের চেনেন বুঝতে পারবেন। আর  একজনের কথা শেষে বলি  আমার দ্বারা নিপিড়ীত, উদাসীন  এক ভদ্রলোক যাঁকে নিয়ে  আমি গত কয়েক বছর চলছি। তিনি এখন আমার অনেক অজানার ইস্কুল। তিনি সহ এ জীবনে যাঁর থেকে যা যা শিখেছি, বিদ্যা থেকে জীবনপাঠ সমস্ত শিক্ষকদের আমার অন্তরের প্রণাম। এঁরা সকলেই শ্রেষ্ঠ বলে এঁরা শিক্ষক।

No comments:

Post a Comment