Monday, 11 November 2019

খরচের খাতায়

#খরচের_খাতায়
জমার উল্টোটা যদি খরচ হয় তবে আমি খরচে। এ আমার জিনগত বৈশিষ্ট্য। 
আমার বাবা-মার ধাতে সেভিংস ব্যাপারটা কোনও কালে নেই।  দু জনেই প্রচন্ড খরচে। এ আমাদের আত্মীয় স্বজন সকলে জানেন। এবং এ জন্য সারা জীবন আমাদের যৌথ পরিবারে বিস্তর জ্ঞান শুনেছেন ওঁরা। বাবা ছিলেন চরম আত্মভোলা, লেখাপড়ায় ডুবে থাকা মানুষ। আর মা প্রায় সংসারী। কিন্তু দুজনেরই কমন ইন্টেরেস্ট ওই খরচে। যেহেতু দুজনেই রোজগেরে ছিলেন তাই কেউ কারও খরচে মাথা ঘামাতেন না এই যা রক্ষে।  আমি কিন্তু সে জন্য আজীবন ভেবেছি আমি প্রচুর জমাব। এবং আমার জীবনে এমন একজন ত্রাতা আসবেন যিনি আমায় জমানোর ব্যাপারে সম্যক পরামর্শ প্রদান করিবেন। পরামর্শদাতা প্রয়োজন কারণ   আমি নিজেও  ছেলেবেলা থেকে সমস্ত ব্যাপারে একটু আলুথালু। যারা আমায় চেনেন তারা জানেন নিত্য জিনিস হারানো আমার রুটিনের মধ্যে। টাকাও আমার মাঝে মধ্যেই হারায়, চুরিও যায়। এ জন্য আমি আমার চেয়েও বেশি আলুথালু আমার মায়ের থেকে প্রচন্ড বকাও খেয়েছি। আমি,আমার বাবা, মা এবং কিছুটা হলেও দিদির ভুলের গল্প নিয়ে আস্ত উপন্যাস হয়ে যেতে পারে। তাই বলছি টাকা হারানো  যদি খরচের মধ্যে পড়ে তবে আমি বেজায় খরচে। আমার বাকি খরচের কথা আমি জানি না। আমার দিদি আমাদের তুলনায় কিঞ্চিৎ গোছানো।  কিন্তু খরচের ব্যাপারে সেও সিদ্ধ হস্ত। এ পর্যন্ত জীবনের  সমস্ত দামী ইচ্ছেগুলো ওই পূরণ করেছে। দিদির ছেলেমানুষ  বয়েসে বিয়ে হবার পর আমার ২৬ বছরের জামাইবাবুকে দেখে আশা জেগেছিল এবার একজন জমানোর লোক এল।ব্যক্তিগত স্তরে জানি না তাঁর জমানোর কথা। কিন্তু কোনও কিছু পাঁচশো লাগলে উনি নিয়ে আসেন পাঁচ কেজি।  কে জানে ভদ্রলোক খরচে কিনা। আর একজন আমার মেসোমশাই, সরকারী চাকুরে আমার মেসো বাজারে গেলে বাজারওলাদের তিনদিনের সংসার খরচ নিয়ে আর চিন্তা থাকে না। সে জন্য উনি বাজারে হেব্বি পপুলার।
কাজেই  বোঝাই যাচ্ছে ছাত্র জীবনে আমি এমন একটা খরুচে আবহাওয়ায় বড় হয়ে উঠেছি। ছেলেবেলায় জমানো বলতে মাসিপিসিদের থেকে পাওয়া দশ বিশ টাকা দিদুর হাতে দিয়ে রাখতাম। ওইটেই আমার জীবনের একমাত্র শক্ত পোক্ত সেভিংস একাউন্ট।
ভেবেছিলাম চাকরি যদি করি তাহলে অতি অবশ্য টাকা জমাব। তা আমি আমার ব্যাচেলার চাকরি  জীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছি একটা ভাড়া করা ফ্লাটে আমি আর আমার বোন সমা বান্ধবী সন্টুর (নবনীতা)সঙ্গে।সেখানে বেচারার কাজই ছিল আমার জিনিস গোছান। আমায় বেশ বকাবকিও করত অগোছালো স্বভাবের জন্য। আবার বকাবকি করে গুছিয়ে রেখেও দিত সব।  প্রথম প্রথম এক সঙ্গে থাকতে শুরু করে আশায় ছিলুম এমন গোছানো গাছান মেয়ে ও নিশ্চয়ই আমাকে শেখাবে কি করে জমাতে হয়। ও হরি, এ মেয়েও যে  জলের মত টাকা খরচ করে। 
অগত্যা শেষ আশা ছিল বিয়ে। বিয়ে করে টাকা জমাব। কোথায় কি! আমার পতি দেবতা উচ্চ মার্গে বিচরণ করেন সর্বদা। আজ অব্দি এক পয়সা জমাননি। বললেই বলেন কি করবি জমিয়ে সর্বং খণিকং,খণিকং।।
বাকি রইল আমার শ্বশুর, শাশুড়ি।  শ্বশুরমশাই রোজ পাঁচ রকম মাছ আর অকারণ জিলিপি কচুরি  করে পেনশনের টাকা ফুরিয়ে ফেলেন জানি। বাকিটুকু অজানা। কিন্তু যার গল্প দিয়ে খরচের গল্প শেষ করব তিনি আমার শাশুড়ি।  
তার দুখানা  গয়নার দোকানের ছোট লাল ভেলভেটের ব্যাগ আছে। একখানা সবার সামনে বের করেন। আর একখানা গোপনে রাখেন। কেবল আমি জানি। তা উনি রোজ বাংলা ইংরিজি মিলিয়ে চারখানা খবরের কাগজ পড়েন কিন্তু ভাবেন এখনও দার্জিলিঙে গেলে পনেরো টাকায় উলের ব্লাউজ পাবেন।  চারশো টাকায় টিস্যু বেনারসি কিনব এই আশায় গোপন আর ওপেন ব্যাগ নিয়ে রেয়ারলি গড়িয়াহাট যান আর সাতহাজার টাকার বাজার করে ফেরেন।কেবল  নিজের জন্য নয় খুড়তুতো বোন থেকে বৌমার মাসি যে কেউ থাকতে পারেন সেদিনের বাজারের লিস্টিতে। ফিরে বরের  কাছে অবধারিত বকা খাবেন, এ ভাবে পেনশনের টাকা নষ্ট করার জন্য।আমি মনে মনে ভাবি কে কাকে বলে! শাশুড়ি অভিমান করেন। জীবনে যতগুলো না করা চাকরি, এবং যেগুলোর করার সম্ভবনা  ছিল সেগুলো এই সংসারের জন্য কেমন করে ছেড়েছেন তার কথা বলেন।সেখান থেকে  উনি ফিরে যান সত্তরের গোড়ার দিকে ওনার কলেজ জীবনে, বসন্ত মালতি, ওলি সেন্ট আর ১৪ টাকার র সিল্কের ব্লাউজে। আর বলেন ঠিকই আছে যা ভেবেছি তার চেয়ে অল্প একটু বেশি খরচ হয়েছে বলো। আমি মনে মনে ভাবি উনি যা ভাবেন সেটা কি বলেন না, নাকি যা খরচ করেন সেটা মনে রাখেন না। 
আমি কি আর করি বলি মা তোমার তো অনেক খরচ হয়ে গেলো আমি বরং তোমায় কিছু দি? আমায় চোখ টিপে বলেন নানা চিন্তা করো না, ওসব তোমার বাবাকে বলি।আমার ওই ব্যাগে গোপন অনেক টাকা আছে। ওই টাকা আমি ভুলেও খরচ করি না। তোমার বাবার থেকে কেঁদে কেটে নিই। আমি সরল বিশ্বাস থেকে ভাবি যাক একজন তো জমাতে পেরেছে আমার জীবনে। 
তা এই মাসখানেক আগে আমায় শাশুড়ি বললেন আমায় একটা ভালো ব্যাগ দাও তো, আমার জমানো টাকার ব্যাগের চেন কেটে গেছে। এই টাকা জমানো  ছাড়া সমস্ত ব্যাপারে আমার শাশুড়ি আমার চেয়েও বেশি অগোছালো । তাই বললাম দাও তোমার টাকাগুলো নতুন ব্যাগে গুছিয়ে রেখেদি। দেখলাম ওঁর গয়নার দোকানের লাল ব্যাগটা একেবারে পেট মোটা হয়ে ফুলে উঠেছে। ভেতর থেকে টাকা বের করতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। একবছর আগে ডেট পেরিয়ে গেছে এমন লন্ড্রির বিল থেকে ২০১৪ সালের ট্রেনের টিকিট অব্দি সব আছে। ভাবুন এটুকু ব্যাগে আর টাকার জন্য কতটুকুই জায়গা থাকে।  ক্রমশ আশার আলো নিভছিল। তবু ভাবলুম জমানো টাকা কখানা দেখি।  হায়রে  দু এক খানা দুহাজারের নোটের পরেই এক গোছা পাঁচশ টাকার নোট। সবই নোট বাতিলের  জমানার টাকা। আমি বললাম একি করেছ। তুমি এগুলো এখনও রেখে দিয়েছ। পাল্টাওনি কেন। বললেন পাগল তোমার বাবা জানতে পারবে  আমার জমানো টাকার কথা, তখন? আমি বললাম তুমি রোজ এতগুলো খবরের কাগজ পড়, জাননা এই সব নোট বাতিল হয়ে গেছে। বললেন NRI রা পাল্টাতে পারে। তোমার দিদি এলে ওর হাতে দেব। আমি বুঝলুম ওঁর জমানো পুরোটাই খরচের খাতায়। কোন কচুবনে তপস্যা করেছিলুম কে জানে। আমার চেয়ে উপযুক্ত শ্বশুরবাড়ি আজ অব্দি ভূভারতে কোনও মেয়ের হয়েছে কি?

থাকুক বর্ষার রাত্রিরা


বন্ধ ঘরে শুয়ে থাকলেও আমি টের পাই আজ মেঘ করেছে। আমার মাথার যন্ত্রনা হয়। তাই অনেক বর্ষার সকালেই উঠি আমি খিঁচখিঁচে মেজাজ নিয়ে। অথবা ওঠার আগেই মনে হয় স্নান করার গামছা থেকে অন্তর্বাস সব আধশুকনো হয়ে থাকবে, কেমন গুমসুনি গন্ধ, বমি আসে আমার।রান্নার দিদি আজ বর্ষার জলে ডুব দেবেই,  তাই বর্ষার শর্টকাট ফরমুলা খিচুড়ি হবেই হবে। খিচুড়ি দেখলেই আমার দিল্লির হাসপাতালের স্মৃতি মনে পড়ে। বাবা গো সেই ওষুধের গন্ধমাখা খিচুড়ি।   
আমার তিনশ বছরের পুরনো শ্বশুরবাড়িখানা প্রত্যেক বর্ষারদিনে মনে হয় ছেড়ে চলে যাই। এতো বড়বড় ফ্লাট চারপাশে। ওগুলোর ভেতর এই ঘোর বর্ষাতেও শুকনো খটখটে।  অথচ এই বাড়িটাতে বৃষ্টি পড়লে  ঝুল বারান্দার হাঁড়ি বসাতে হয়। কড়িবরগার ফাঁক বেয়ে সেই হাঁড়িতে টুপটুপ করে জল পড়ে। এরা বলে এসব বাড়ির ঐতিহ্য, এসব ছেড়ে যাওয়া যায় না। আর আমার ভয় করে পা পিছলে পড়ে আমার এল ফাইভ আর এল সিক্সে ফাঁক হয়ে গেলে কাজ কর্ম সব বন্ধ। চার্নকের আমলের মেঝে খুঁড়ে বাথরুমে মার্বেল বসালেও কেঁচোগুলোও এই বাড়ির সদস্যদের মতই অনড়, এই পুরনো বাড়িখানা ছেড়ে যেতে চায় না কিছুতেই। বাথরুমের দেওয়াল ধরে হেঁটে চলে বেড়ায় আর দেওয়ালে আঠালো দাগ রেখে ওরা ডেস্টিনেশন খোঁজে। আমার স্নান করতে গিয়ে গা ঘিনঘিন করে। তাই বর্ষা পড়লেই আমি চোখখুলেই একের পর খুন করতে থাকি, আসিড ঢেলে ঢেলে। আর  লেডি ম্যাকবেথের মত কেঁচোর আঠালো দাগ দেখতে পাই হাতে। এইসব কেঁচো টেঁচো মেরে, দুর্গন্ধযুক্ত অন্তর্বাস পড়ে,  খিচুড়ি গিলে, হাঁটু ডোবা জল ঠেলে ডায়মন্ড হারবার রোডে গিয়ে অটো ধরি আমি।  কফ, থুতু, পেচ্ছাপ মেশা জল মাখা শরীর নিয়ে সারাদিন ডিও মেখে ঘোরা আমার পোষায় না আমার। মনে হয় আপিসে গিয়ে লাভ ক্ষতির হিসেব মেলান যায় না। সবটাই ক্ষতি মনে হয়। আমি তো আসলে সংসার নয়, অফিস নয় অন্যকিছু করতে চেয়েছি আজীবন। কি যে সেটা বর্ষার সকালে মনে পড়ে না কিছুতেই।সারাশীত সারা গ্রীষ্ম আমি কোনও ফুটপাতবাসীর কথা ভাবি না। প্রবল দাবদাহে অথবা ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় লোক মারা গেলে কেবল খবরের কাগজে পড়ি। কিন্তু বর্ষা হলেই গরীব মানুষের জন্য দরদ উথলে ওঠে আমার। আমি তখন সাম্যবাদী হয়ে যাই। নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারি ওদের সঙ্গে। সারাদিন বর্ষার কোনও রোমান্স আমার মনে জাগে না।
অথচ দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরি তখন বেহালার জমা জলগুলোকে  ভেনিস মনে হয়। শাশুড়ির হাতের গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি আর শ্বশুরমশায়ের আনা ইলিশের কথা মনে পড়ে। বাড়ি ফিরে আধভেজা গামছায় মুখ মুছতে মন্দ লাগে না। এসে পরনে জামা কাপড় ধুয়ে দিতে দিতে মনেই হয় না কাল এরা আধশুকনো থাকবে। বাথরুমের দেওয়ালে কেঁচোরা হেঁটে বেড়ালে দেওয়ালে কতরকম ডিজাইন তৈরি হয় আমি দেখি। আমার মুখোমুখি হয় কত কেঁচো, আমাদের হাসি বিনিময় হয়। ওরা ভাবতেই পারে না কাল সকালে আমার হাতে খুন হবে ওরা। আমিও ভাবি না তখন কোনও হত্যার কথা। রাত্রিবেলায় যখন অঝোর ধারে বৃষ্টি নামে তখন সারাদিনের লেগে থাকা আবর্জনা ধুয়ে যায় শরীর থেকে। কড়ি বরগা থেকে হাঁড়িতে টসে পড়া জলের শব্দে মনে হয় জলতরঙ্গ বাজছে।
বর্ষার রাতে আমি চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাই  সেই সব মেঘেদের যারা নির্বাসিত যক্ষের বার্তা নিয়ে উড়ে চলছে অলকায়। সেই সব উড়ন্ত মেঘেদের ব্যাকগ্রাউন্ডে মেঘমল্লার বাজে । আমি কখনও শান্তিনিকেতনের বর্ষা দেখিনি অথচ বর্ষার রাতে চোখ বুজলে দেখতে পাই কদম ফুল থেকে চুঁইয়ে পড়া জল। শুনতে পাই কে যেন গাইছে ”বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান"
এই বর্ষার রাতগুলোতেই আমার মনে হয় আমি মংপুতে কোনও কাঠের বাড়িতে বসে পাহাড়ের বৃষ্টি দেখছি। আমার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে মৈত্রেয়ী  দেবীর বাড়ি,  সেখান থেকে ভেসে আসে   "শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনী রে " বর্ষার রাতে আমি জঙ্গলের ট্রি হাউসে আছি বলে মনে হয়। সেখানে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আওয়াজ আর ঝিল্লির ডাক মিলে মিশে এক মায়াময় শব্দ তৈরি হয়।  মনে হয় আমি তো জীবনটা কেবল এমন শব্দ শুনেই কাটাতে চেয়েছি।  শুধু এ জন্যই বেঁচে থাকা এ জীবনে। মনে হয় "সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব" 
আচ্ছা কোনওদিনও বর্ষার সকাল না এলে কী হয়। থাকুক না বর্ষা জুড়ে কেবল রাত্তির। বর্ষার দিনগুলো বড্ড ডিপ্রেসিভ।

আশায় আশায়


নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয় আমার। আফগানিস্তান থেকে আলমবাজার সর্বত্র নিজেকে দেখতে পাই ঘুমের মধ্যে। উপায় কী! পা চলে তো পকেট চলে না। পকেট আনা দু আনায় ভরে উঠলে শরীর চলে না অথবা সময় নেই বলে সময় বয়ে যায় বেশ খানিক। অগত্যা যাযাবরের জীবন কাটে এই ফেসবুকে, ইউটিউবে ইনস্টাগ্রামে অথবা গুগুলে।
এই সব সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ালে আপনি সমাজ, সংসার অন্তর সব দেখতে পাবেন। এখানে ঘুরে বেড়ালে বুঝবেন সাম্যের ধারণা কত ভুল অথবা বস্তাপচা। এখন তো হাতে হাতে মোবাইল আর মোবাইলে মোবাইলে ফেসবুক। সবাই ফেসবুকে আছি মানে বালিগঞ্জ আর বনগাঁর বন্ধুত্ব হবে ভাববেন না।  সোনারপুর হয়ত সাউথ সিটির ফ্রেন্ডলিস্টে থাকে কিন্তু তাদের মধ্যে বিস্তর তফাত। এখানে হিন্দু মুসলমান, বাম, বিজেপি, তৃণমূল, ছেলে,মেয়ে,হিজড়ে, কালো, ফর্সা, লম্বা, বেঁটে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত,  এম.এ, বি.এ, ডাক্তার, এঞ্জিনিওর ব্রাহ্মণ, শূদ্র এমন হাজার হাজার ভাগ আছে।  ক্লাস ডিফেরেন্স অতি স্পষ্ট।  উদাহরণ স্বরূপ বলি খুব নাম করা এক মহিলা লেখককে দেখি রোজ ফেসবুকে লেখেন, গান গান, গাছ পালার ছবি দেন, রান্নার ছবি দেন, নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করেন। অসম্ভব সুন্দরী সেই লেখককে আমি রোজ দেখি। আর মনে মনে তাঁর মত বাঁচতে চাই। তা সেই লেখকের অগণিত ভক্ত, তারা তাঁর ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টেই আছেন। মহিলা আক্টিভ হলেই তারা মন্তব্যের ঝড় তোলেন। এতো যে সবাইকে উত্তর দিতে হলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন। তাই মহিলা বেছে বেছে উত্তর দেন, লাইক দেন, লাভ দেন। কাদের বেছে নেন যাঁরা তাঁর ক্লাসের। একই রকম সোশ্যাল স্টেটাস। ধৈর্য অগাধ,  নাহলে দেড়শ মন্তব্যের ভিড়ে ক্রিম অফ সোসাইটি বাছা মুখের কথা নয়। আমার আগে ভারি রাগ হত। মনে হত বেশ তোমার সবাইকে উত্তর দেওয়ার দরকার নেই,  সব মন্তব্যের প্রতিমন্তব্য হয়ও না, কিন্ত একটা চিহ্ন তো আঁকা যায়, কান্না,হাসি,ভালোবাসা, রাগ কতই তো চিহ্ন দেওয়া এখানে। তাই যদি না পারো কাউকে দিও না। আরে বাবা তোমার লেখক বন্ধুর অথবা বড়লোক সুগৃহিনীর রয়্যালটিতে কি জীবন চলবে, চলবে তো এদের জন্য। পরে মনে হয়েছে বেশ করে। অন্তত তাঁর অন্তরটি তো দ্যাখা যায়। মনে মনে ক্লাসলেস বলে গাল দিয়ে আয় গলা জড়াই বলে সোশ্যাল ওয়ার্ক করার চেয়ে এই ভালো।  যে জিনিস ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে তার জন্য কাঙালপনা বাড়ে তিনি জানেন।
এই যে সাজানো  ডিশ, সাজানো  ঘর, সাজানো আমি,  এইটেই কেবল সারসত্য হয়ে ধরা দিক মানুষের কাছে এই তো সকলের কাম্য। সেই তাসের ঘরের বউটিকে মনে পড়ে আজকাল খুব। ভেতরের ফোঁপরা জীবনটুকু আড়াল করার নামই সোশ্যালমিডিয়া। এই সব মিডিয়ামগুলো আসলে ফরাসি পারফিউমের গন্ধ। আপনার বাতকর্মের গন্ধটুকু আড়াল করার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিচ্ছু পাবেন না। 
আমি নিজেও তো নির্লোভ,  নির্মোহ নই। আমার মধ্যেও ছলনা, কপটতা  ভণ্ডামি ঈশ্বর ঠেসে ঠেসে দিয়েছেন। তবু ভাবি মুক্ত হব কোনও দিন সব কিছু থেকে।  তাই কদিন মনকে প্রবোধ দিচ্ছি পুকুরঘাট আসলে বৃহৎ সত্যের সন্ধান আর আমার নিজের দ্যাখাটাই সংকীর্ণ। আশা হারান পাপ এটুকুই একমাত্র সত্য, এই আশা নিয়ে আমি রোজ পুকুরপাড়ে এসে বসি আর আপনাদের ডাকাডাকি করি।

যাতে প্রতিবাদ ভালো হয়

#যাতে_প্রতিবাদ_ভালো_হয়
যাঁরা ভাবছেন প্রতিবাদ করে পরিবর্তন আনবেন তাঁরা এই সমস্ত ডিপ্রেশনের দিনে ঘরে বসে না থেকে বেরিয়ে পড়ুন। অবশ্যই আপনার বাড়ির গাড়িতে নয়। পায়ে হেঁটে অথবা বাসে, ট্রেনে, মেট্রোতে। ধরুন আপনি হাজরা মোড়ে  ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন বাসের আশায় দেখবেন আপনার পাশের লোকটি প্যান্ট খানিক গুটিয়ে, বাঁ বগলে ফাইল নিয়ে, বাঁ হাতে একটা শিক বের করা ছাতা নিয়ে, ডান হাতে সদ্য নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ঠোঙায় বাজার নিয়ে, কাঁধ দিয়ে কানে ফোন চেপে উচ্চগ্রামে গিন্নির কাছে আবদার করছে খিচুড়ি খাবার, সে জন্য সে  মাস  শেষে চড়া দামে অসময়ের ফুলকপি কিনে নিয়ে যাচ্ছে এ কথাও আপনি শুনতে পাবেন। বিকট চিৎকার আর ঘরের কথা পাবলিকলি বলা আপনার যতই আনসিভিলাইসড মনে হোক এমন এসব ডিপ্রেশনের দিনে এক হাত অন্তর এসব ঘটেই থাকে। অথবা যে ব্রান্ডেড ভুজিয়াওয়ালার থেকে আপনার ড্রিংসের চাট আসে তার দোকানের নিচে দেখবেন সাতখানা প্লাস্টিকের চিরুনি, আর কয়েকটা প্লাস্টিকের আয়না নিয়ে মাটিতে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। কোমর থেকে সপসপে ভিজে ওই বৃদ্ধের চুলে কিন্তু চিরুনি পড়েনি আজ। আর বৃদ্ধের না বিক্রি হওয়া প্লাস্টিকের আয়নায় জলের ছিটে আর চলমান জীবনের ছবি দেখতে পাবেন একটু উঁকি মারলেই। দেখবেন রোজকার চা ওয়ালা বৌদি ভিজে সপসপে মানুষগুলোকে চা দেবে বলে ডেচকি থেকে মগের ওপরে রাখা  ন্যাকড়াতে চা ঢালছে আঁচল দিয়ে ধরে। সরে যাওয়া আঁচলের ফাঁক দিয়ে তাঁর একখানা হুক খুলে যাওয়া বুকের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে কেউ কেউ তাকিয়ে আছে জেনেও, যতক্ষণ না চা ঢালা হয় আঁচল টানার উপায় নেই তাঁর। দেখবেন রাধা গোবিন্দর মন্দিরের সামনে ফুলওয়ালারা ফুলে প্লাস্টিক চাপা দিয়ে, হাতে এক গোছা গোলাপ নিয়ে বিষন্ন মুখে বসে আছে। যদি কোনও প্রেমিক এই ভরা বৃষ্টির দিনে একথোকা গোলাপ নিয়ে যায় সেই আশায়। আর রজনীগন্ধার স্টিকগুলো দেওয়াল ধরে  মাথা উঁচু করে দাঁডিয়ে আছে। কত দূরেই বা ক্যাওড়াতলা শ্মশান,  চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল থেকে যারা লাস হয়ে বেরোয় তাদের ডিপ্রেশনেও রজনীগন্ধা লাগে। আর দেখবেন ফুলওয়ালার ডাঁটি ভাঙা চশমার কাচ জলের ছিটে লেগে  কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। এইবারে বাসে ওঠার পালা। যথারীতি আজ আপনি জায়গা পাবেন না। উঠে আপনাকে বলতেই হবে দাদা একটু পেছন দিকে এগোন না। পেছনটা খালি আছে। আমরা ঝুলছি। তারপর কোনও রকমে ডজ মেরে গিয়ে একটা রড ধরে সেট হয়ে যান। মাঝে মাঝে বলতে থাকুন দাদা ছাতা সামলে, প্লাস্টিকের প্যাকেট আনতে পারেন না বাড়ি থেকে আপনার ছাতার জলে ভিজে গেলুম ইত্যাদি। এসবের মাঝেই যারা সিটে বসে আছেন তাঁদের প্রচন্ড ঈর্ষা করতে করতে ওঁদের গল্পেই মশগুল হয়ে যান। দেখবেন NRC থেকে বিক্রম, ডি. এ বাড়া না বাড়া থেকে হিন্দি আগ্রাসন, মমতা, মোদী আর সিপিএম কে বেশি খারাপ নিয়ে মতান্তর অথবা মতানৈক্য, বাঙালি জাতির ধ্বংসের  সম্ভবনা এসব নিয়ে  তুমুল আড্ডা চলছে। একজনের পায়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোও তাতে মিশে যাচ্ছে দিব্য। কারও কারও কণ্ডাক্টর সঙ্গে একটাকা  বেশি ভাড়া নিয়ে তুমুল তর্ক হচ্ছে। তাতে সমবেত ভাবে বহু স্বর শোনা যাচ্ছে রোজ রোজ এই এক টাকার চালাকি আর চলবে না বলে। তার মাঝেই কেউ বলছে তার মেয়েও ভালো গান গায় কিন্তু রানুদির মত কপাল নয়। দেখবেন এদের সমস্ত গল্পের মাঝখানে কেমন কান্না মিশে থাকে। এমন কি হাসিতেও। এসব সামলে ধীরে ধীরে আপনার বাড়ির স্টপেজে নেমে যান। তারপর আপনার তেইশ তলার ফ্লাটে লিভিং এরিয়ায় বসে চিন্তা করুন কাল ফেসবুকে অথবা কোনও এসি সভাকক্ষে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় যাদবপুরের পক্ষে থাকবেন না বাবুল সুপ্রিয়, নাকি কাউকেই না চটিয়ে ট্রাম্পে চলে যাবেন সোজা। সঙ্গে হালকা সিম্ফোনি, কাঁচের গেলাসে দামি হুইস্কি আর আর আপনার টেরেস গার্ডেনের ট্যোমাটো স্যালাদ মাস্ট। তাতে বিপ্লব ভালো হয়।
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায় 
২৫.০৯.১৯

উৎসব প্রিয় বাঙালির পুজো ও প্রস্তুতি


--------------------------
 উৎসব প্রিয় বাঙালিরা দুর্গা পুজোর কেনাকাটা শুরু করেন চৈত্র সেল থেকে।  অপছন্দের আত্মীয়দের এবং হঠাৎ আসা পূজা গিফটের, রিটার্ন গিফট হিসেবে যা দেওয়া হবে তা এই সময় কিনে ফেলা হয়। এ ছাড়া পুজোয় ঘরে পাতার বিছানার চাদর, ঠাকুরের শাড়ি এবং পুরুতের গামছা ও নিজের  দুর্গা পুজোয় হতে পারে শাড়ির কথা ভেবে চার জোড়া সায়া উৎসব প্রিয় বাঙালি চৈত্র সেলেই কেনেন 🛍। 
আসল কেনা আরম্ভ হয় পুজোর দেড় মাস আগে থেকে শুরু করে পঞ্চমীর দিন পর্যন্ত। এসময় দোকানে গেলে হামেসাই শুনবেন  'না অত ভালো দিতে হবে না । এটা নিজের জন্য নয়, লোককে দেবো’🙄। 
এবার নিজেরটা পছন্দের পালা, এই কাজে সাত দিন থেকে সতেরো দিন লাগতে পারে। বাজেট নিজের চার থাকলে অন্যদের থেকে পাঁচশো করে কমিয়ে সাত থেকে দশে চলে যায়। আদর্শ পুরুষরা কিন্তু এসব বুঝেও না বোঝার ভান করেন🙄🙄। নচেৎ পঞ্চান্নতেও প্যান্ডেলে বসে বাইশের মেয়েকে বৌমা না ডেকে 'বৌদি ভালো তো' বলা, 'কত্তার আজও অফিস' বলে খুঁচিয়ে ঘা করে হোয়া নম্বর নেওয়া অসম্ভভ। বন্ধুদের সঙ্গে অষ্টমীর বিয়ার পার্টিও অসম্ভব🍷🍾। পারমিশনই পাবেন না। 
 জামা কাপড়ের বাজারে গেলে আপনি কিন্তু রকম ফের পুরুষ পাবেন উৎসব উপলক্ষে।  বাজার লাভার পুরুষ এবং বাজার হেটার পুরুষ। দুদলই যদি বিবাহিত হন গিন্নির সঙ্গ দান করেন, ভালোবেসে ও না বেসে। অনেক বিবাহিত পুরুষ আবার মাখো মাখো সম্পর্কের মহিলা কলিগের বা বান্ধবীর  সঙ্গ দান করতেও জামা কাপড়ের দোকানে ঘোরেন।  সাম্প্রতিক অতীততে সবাই দেখেছি তাই উদাহরণ আর দিলুম না 🤫। এক দল পুরুষ অবিশ্যি নিজের উৎসবের পরিধান নিজে কেনেন। তারা হয় অবিবাহিত নয় বিবাহ বিচ্ছিন্ন, নয় বৌ তাদের নারীবাদি বা কমুনিস্ট অথবা বিয়ের পর বউয়ের সঙ্গে কেমিস্ট্রি জমে ওঠেনি, একেবারেই বউয়ের  রুচি, বুদ্ধির ওপর আস্থা নেই। ❌
 আর এক দলের কেনাকাটা বান্ধবী বা বৌরাই করেন। এরা বেশি বুদ্ধিমান। বাজার প্রিয় রমনীরা রুমাল, জাঙ্গিয়াও একটা লাগলে দুটো কেনেন। কুর্তা আর টি শার্ট আর নাই বা বললুম। এদের কেউ জিজ্ঞেস করল ধরুন 'স্যান্যাল দা কোথা থেকে নিলেন জামাটা? এই সব পুরুষদের উত্তর হয় ’এটা? কে জানেরে তোর বৌদি কোথা থেকে কিনেছে’ যাচ্চলে কিনে যখন এলেন বৌদি, বিলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভুলে গেলেন 🤔!
আবার কোনও কোনও বাজার প্রিয় পুরুষ বৌকে নিজে পছন্দ করে কাপড়, সায়া, ব্লাউজ এনে দেয়। সেই সব বৌরা বলেন ’আমি বাবা কিনতে কাটতে পারিনা তোমার দাদা এসব ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট’, 👰। 
এই সব মেয়েদের ভাববেন না নিপীড়িত।  এদের ক্ষেত্রে দাদারা আপিস গেলে বাড়িতে বেচতে আসা শাড়িওলার কাছে মাসে মাসে খাতা চলে।
 উৎসব প্রিয় মেয়েরা যখন পার্লারে যায় ফর দুর্গা পুজো অনলি, তখন অবিশ্যি  মহালয়ার হয়ে যায়, চলে পঞ্চমী অব্দি। চুল অবিশ্যি  একটু আগে কাটে💇।  এ সময় ভুরু ছাঁটে আর মুখ পালিশ করে। ওখানেও টিকিট হাতে ডাকের অপেক্ষা করতে হয়, এবং এ সময় ছেঁটে ডান ভুরুর সঙ্গে বাঁ ভুরু ম্যাচ করে না। গড়িয়া হাট থেকে জাঙ্ক জুয়েলারিও এসময়ই আসে। এবং এই সব মহিলারা জুতো কেনার জন্য ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন যতদিনে না খাদিম বা শ্রী লেদার্সে ঢুকে ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে অনলাইনে জুতো কেনা হয়ে যায়, এবং মাপে ফিট হয় না,এই নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের লেডিস গ্রুপে কান্নার ইমোজি সহ খবর পৌঁছে দেন তাঁরা 😭এবং জুতোর দাম মিনিমাম তিনশো টাকা বাড়িয়ে বলেন।এ ক্ষেত্রে কেসটা বয়েসের উলটো।👠👡  জুতোর  ব্যাপারে পুরুষরা বেশ সৌখিন। মহিলাদের চেয়ে দামী জুতো পরা তাদের জন্মগত অধিকার। জুতো কোম্পানিরাও এ ব্যাপারে চরম patriarchy তে ভোগেন। জুতোর দামও রাখেন সেই হিসেবে 👢।
এরপর পুজোর দিনগুলোতে সেই জুতো পরে শালী সহযোগে কেউ কেউ ঠাকুর দ্যাখেন। গিন্নিরা অবশ্য দেওর, ননদের নিতে পছন্দ করেন না। হামলে রোল খান কত্তা গিন্নি বা প্রেমিক প্রেমিকা দুজনেই। (তার আগের দুমাস প্রবল ডেয়েটিং সেদিন ভঙ্গ হয়) মেয়েরা কেবল কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল হাতে নেন। বাচ্ছা থেকে গিন্নির হিল ভাঙা জুতো বাকি সব দ্বায়িত্বই পুরুষের এই ঠাকুর দ্যাখার দিনগুলিতে। গিন্নিরা লাইনে খুব এক রোখা, কাউকে এক চুল জায়গা ছাড়েন না। কত্তারা কিঞ্চিৎ দয়ালু, ডিপ কাট ব্লাউজের বৌদিকে আগে ছেড়ে দেন। আবার যদি সে বৌদি ইংরেজিতে সাহায্য চান তো কথাই নেই। 
এরপর আছে রেস্তোরায় লাইন দেওয়া। কাঙালি  ভোজন এবং বস্ত্রদানের লাইন এর চেয়ে ডিসিপ্লিনড হয়। খাবারের দোকানের চেহারা নাই বা বললুম। 
জেনারেশন নেক্সটের আরেক সঙ্কট👧👦, বিশেষত ষোল থেকে সাড়ে সাতাশ।  তারা অন লাইনে জামা কেনে, অধিকাংশই ফিট করে না, তাও পরে। তারা ভুলে যায় দুর্গা পুজো ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পনশর করে না। কাজেই মার্কিনি হাফ প্যাণ্ট, গোড়ালি অব্দি মোজা আর নর্থ স্টার পরে ঠাকুরের লাইনে দাঁড়ালেও মশারাও পিছু ছাড়ে না, আর ভাদ্দরের গরমও কমে না। এদের উন্মুক্ত পদযুগলে থাবড়ে থাবড়ে মশা মারতে হয়, এবং ফাস্ট ফুডের মোটা শরীরে টাইট সিন্থেটিক টি শার্টে গ্যাল গ্যাল করে ঘাম হয়। ব্যাপারটা দৃশ্যগত ভাবে ভালো না। বিশ্বাস করুন পোশাক হিসেবে আমার বিকিনিতে বা ছেলেদের উন্মুক্ত বক্ষেও আপত্তি নেই। কিন্তু ওডোমশ মেখে পোশাক পরা যায় না। 
যাই হোক জেনারেশন নেক্সটকে তার ওপর বাপ, মা বাংলা কালচার থেকে দূরে রাখবেন বলে  বলে অসুর আর গণেশের তফাৎও শেখাননি, কাজেই বেচারারা এতো লাইন দিয়ে কি যে দ্যাখে কে জানে। অনেক সময় কিছু না বুঝে দুগগা ফ্যামিলিকে ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমার ক্যারেক্টর হিসেবে ভেবে নেয়।  দাদা, বৌদি, মাসিমা, মেসোমশাই এসব করে সপ্তমীর সকালে তারকেশ্বরের জল যাত্রীর মতো পা ফুলিয়ে বাড়ি ফেরেন। কাল নর্থ কভার করবেন অথবা স্রেফ প্যান্ডেলে থাকবেন এই প্লানিং নিয়ে। আজ এই অব্দি। শুভ সপ্তমী। 
ডিসক্লেমার ১- কাল লিখে নিমকি চেয়েছিলুম আজ নারকেল নাড়ু চাইলুম। চিনির নাড়ু অবশ্যই, এট্টু কপ্পুর দেবেন। বিজয়ার দিন আমাকে কৌট করে দিয়েও দিতে পারেন। অধমের পিতৃদত্ত নাম নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাগ করে আমার নাম মুছে দেবেন না।🙏
ডিসক্লেমার ২- কাউকে আঘাত দিলে ক্ষমা করবেন। এসব পুজোর রসিকতা। আদপে আমি সিরিয়াস মানুষ প্রোফাইল ঘাঁটলেই বুঝবেন। সত্যি বলছি বাঙালির উৎসব বেঁচে থাক। কেবলই তো না পাওয়া। এইটুকু না থাকলে কি নিয়ে থাকে বলুন তো বাঙালি। আমার মত সিনিক বাঙালিকে পাত্তা দেবেন না।  আমরা ঘাটেও নহি পাড়েও নহি। ষোল আনা ফুর্তির ইচ্ছে, অথচ ইন্টেলেকচুয়াল জোনে নাম লেখাবার প্রবল প্রচেষ্টায়, পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ। বেঁচে থাকুক দুগগা পুজো।❤❤ বেঁচে থাক বাঙালির উৎসব প্রিয়তা।

আর কবে দশভুজা হবো

#আর_কবে_দশভুজা_হবো
কোনও কোনও বাচ্ছার মাকে যদি  জিজ্ঞেস করেন বাচ্ছা খুব শান্ত, না? মা উত্তর দেন 'ওই আরকি'।অনেকের আজীবন ওই আরকি হয়েই কেটে যায়। এই যেমন  আমার। চারপাশে সদর্থেই  দশভুজাদের যখন দেখি মনে মনে ভাবি আমি ধোপার গাধা। বরাবর লেখাপড়ায় ওই আরকি। কিছুতেই খারাপ বলতে পারত না কেউ কিন্তু কস্মিনকালেও এক্সিলেন্ট হওয়া হলো না। খেলাধুলো আর নাই বললাম অথচ খেলা দেখতাম বিশেষজ্ঞের মতো। নাচ,গান, ছবি আঁকা ওই আরকি। হাতের লেখা ওই আরকি। লেখার হাত ওই আরকি। গায়ের রঙ ধলা কিন্তু কি নেই কি নেই, উচ্চতা মাত্র পাঁচ, চুল এক কালে ছিল, নাক টিকলো কিন্তু অতিরিক্ত, কান প্রয়োজনের তুলনায় ছোট(নির্বোধ আর বুদ্ধিমান কানের সাইজ দিয়ে মাপা যায়), চোখ বড় কিন্তু টু থেকে চশমা পরে গভীর গর্তে, পৃথিবীর সমস্ত ইন্টিরিওর ডিজাইনিংয়ের সাইট দেখি, কিন্তু স্তুপাকৃত জামা কাপড় আর বইয়ের তাকের জমতে থাকা ধুলোর গতি করতে পারিনা মিতালি দি, মিনতিদের ছাড়া। আজীবন খেতে ভালোবাসি অথচ এ পর্যন্ত, মা, জেঠিমা, শাশুড়ি আর রান্নার মাসির ওপর জীবন কেটে গেলো। স্বামীর জাঙ্গিয়ার সংখ্যা থেকে রোজগারের পরিমান কিছুই মনে রাখতে পারিনা। বেশিদিন চাকরি করতে ভালো লাগেনা, অথচ বেশিদিন বাড়ি বসে থাকলে মনে হয় নিপীড়িত, অসহায় বঞ্চিত। কারো অসুখ করলে সেবা করতে পারিনা অথচ মাথা,ধরলেও বাম লাগানোর লোক চাই। ঠাকুর দেবতায় অবিশ্বাস নেই অথচ জীবনে একখানা ধূপ কাঠিও  ঘোরানো হয়নি। না হলাম বামপন্থী না হলাম দক্ষিণ পন্থী।  আল্ট্রা লেফট তো ভয়েই হব না। ছেলে পিলের বালাই নেই অতয়েব মাতৃরূপেণও নই। উজিয়ে রাত জেগে ঠাকুর দেখতে পারলাম না অথচ মনে মনে হুল্লোড় বেশ ভাল্লাগে। জম্মে নেশা করলাম না অথচ ভালো ওয়াইন দেখলে জিভ লকলক করে। অচেনারা বলে হেব্বি ব্যক্তিত্ব কাছের লোকেরা বলে ক্যাবলা, লুজ টকের পাহাড়। ভরা পঞ্চমীর দিন বসে ভাবছি  আমার ওই আরকি হয়ে জীবন কেটে গেলো মাইরি। আর কবে,দশভুজা হবো?

বাঙালি ভাবুন

আজ বাঙালির জয়। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌরভ গাঙ্গুলির সাফল্য বাঙালিকে গর্বিত করেছে। জানি একদল তীব্র আপত্তি করবেন কেন সৌরভের নাম নোবেল লরিয়েটের সঙ্গে নেওয়া হলো। সেসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য এই পোস্ট নয়। তাই দেবোও না। আমি এঁদের জন্য গর্বিত আমার বিশ্বাস থেকে।
কিন্তু বাঙালির এই সাফল্যের সংবাদ কানে আসার কয়েক ঘণ্টা আগেই এক বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ও বাঙলা পুস্তক বিপণীর কর্ণধারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বইয়ের বিক্রি নিয়ে। তিনি বললেন ’বাঙালা বইয়ের বিক্রি যে খুব আশঙ্কাজনক ভাবে কমেছে তা নয়, কিন্তু ছোটদের বাঙলা বইয়ের বিক্রি ক্রমশ কমছে, এবং দ্রুত কমছে' আমি প্রশ্ন করি, ইন্টারনেটের ব্যবহার কী তার কারণ? উত্তরে তিনি বলেন 'হিন্দি বইয়ের কথা আমি জানি না  ছোটদের ইংরেজি বইয়ের চাহিদা কিন্তু যথেষ্ট ভালো’

বিষয়টি বাঙালির জন্যে এবং বাংলাভাষীর জন্য যথেষ্ট আশঙ্কার। ছোটদের বাংলা বইয়ের বিক্রি কমছে মানে ক্রমশ একটা প্রজন্ম বাংলা ভাষা বিমুখ হচ্ছেন। কাজেই আর দশ পনেরো বছরের মধ্যে এই ছোটরা যখন বড় হবেন তখন বড়দের বাংলা বইয়ের বিক্রিও কমবে। এতে বাংলা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কেবল বিপদ নয় এর থেকে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে বাঙালি ক্রমশ বাংলাভাষা বিমুখ হচ্ছে। একজন আমেরিকান ইন্ডিয়ানের(বাঙালি) নোবেল আর একজন বেহালার বাঙালির বিসিসিআই-এর সভাপতিত্বে বাঙালির সন্তুষ্ট থাকা যথেষ্ট নয়, কেবল বাঙালির জয় নয় বাংলা ভাষার জয় অচিরেই প্রয়োজন। ভাষা না থাকলে জাতিটিই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে ক্রমশ। ভাববেন না আমি ছিদ্রান্বেষী।  আমি বাঙালির সাফল্যে প্রচন্ড খুশি। কেবল সেই সঙ্গে বিশ্বাস বাংলা ভাষার সাফল্যও প্রয়োজন।

নীলা হবার ১০৮টি উপায়😉


আমি তেমন টিপস জানি না। তবে নিজে যা যা বিশ্বাস করি বললাম। সবকটা ফালতু মনে হতে পারে। অন্যের টিপস একদম নিজের জীবনে আপ্লাই করবেন না, নিজে যা ভালো বুঝবেন করবেন(এটাও টিপস)। কেবল আমার আগের লেখায় কয়েকজন লিখেছেন গা বাঁচিয়ে থাকতে কি করতে হয়, কতটা কতটা খর হতে হয়। তারই কিছু নমুনা দিলুম। চাইলে এক হপ্তা ধরে লিখতে পারি। অজস্র আছে।

টিপস ১
আগোছালো আলনা থেকে আগোছালো জীবন যখন কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারবেন না, গোছানোর ইচ্ছেটাই বাতিল করুন, আর অন্যেরা কত ঠিকঠাক, আমি কেন এমন বলে  নিজেকে দোষারোপ করবেন না। জানবেন যে যত বেশি গোছানো তার শান্তি তত কম। এই বুঝি সব ঘেঁটে গেলো এই চিন্তায় দিন কাবার।
টিপস ২ 
কোনও কিছু  ভালো লাগলে অকপটে বলুন। তাতে নিজে ছোট হবেন না। বরং আপনার একজন বন্ধু বাড়লেও বাড়তে পারে।অনেক সময় যারা নিজেরা প্রশংসা পান তাঁরা অন্যদের প্রশংসার যোগ্য মনে করেন না। আসলে এরা ইনকনফিডেন্ট। এদের মতো হবেন না। এবং আপনার কেউ প্রশংসা করছে না ভেবে হতাশ হবেন না। ইনকনফিডেন্ট লোকেরা অন্যের প্রশংসা করতে ভয় পায়। আপনার ত্রুটি নেই।(এই লেখায় টিপস ২ অ্যাপ্লাই করা জরুরি নয়।)
টিপস ৩
বিনয়ী হোন। কিন্তু প্রয়োজনে রূঢ় কথা বলতে শিখুন। সত্যকথাও, নইলে আপনার মাথায় সবাই চেপে বসবে
টিপস ৪
সাক্রিফাইসিং, কম্প্রমাইসিং হবার লিমিট আছে। দাঁত চেপে এসব যাঁরা করেন তাঁরাও আসলে লোভী,  সুনামের লোভ, দেবী হবার লোভ। একবার এই ট্রাপে পড়লে আর বেরোতে পারবেন না। 

টিপস ৫
চালাক এবং স্মার্ট হবার লিমিট আছে। বেশি হবেন না। মাঝে মাঝে সারল্য প্রয়োজন। 

টিপস ৬
নিজেকে অবলা, হাবাগোবা ভাবা বন্ধ করুন। এতে অনেকে আত্মতুষ্টি পায় বটে তবে দীর্ঘদিন এই অবলার ন্যাকামি করতে করতে কনফিডেন্স তলানিতে ঠেকে।এতে আখেরে ক্ষতিই হয়। 
টিপস ৭
সংসার করতে না পারা থেকে চাকরি তে উন্নতি না হওয়া, সংসার ভাঙা থেকে চাকরি যাওয়া বা যৌন নিপীড়ন কোনও ক্ষেত্রেই নিজেকে ব্লেম করবেন না। আপনার অধিকাংশ সময়েই দোষ থাকে না। তা বলে নিজেকে পারফেক্টও ভাববেন না। বরং দুর্ঘটনা ঘটলে তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করুন।
টিপস ৮
নিজেকে নিয়ে মজা করতে শিখুন। অন্যেরা তাহলে আপনাকে নিয়ে মজা করে আরাম পাবে না।
টিপস ৯
শ্বশুরবাড়ির সমস্যা সহনীয় হলে নিজে মেটান, বাপের বাড়ি এসে বলবেন না। আপনি এক বললে তাঁরা দশ ভাববেন। আপনার বাড়ির লোকেরই দুশ্চিন্তা বাড়বে। বরের কাছে কমপ্লেন করা একেবারে চলবে না।

টিপস ১০
আমার মা বলন যাঁকে খুব খারাপ লাগছে তাঁর ভালো দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করো। নিজে শান্তি পাবে।

টিপস ১১
কেউ অত্যধিক ঘ্যাম দেখালে আপনি একেবারে উলটো আচরণ করুন। মনে মনে অবশ্য বোকা ঘ্যামওয়ালা লোকটিকে নিয়ে মজা করতেই পারেন। প্রথম প্রথম সংস্কৃতি করলে এই টিপস মোক্ষম।

টিপস ১২
যারা গোষ্ঠী বদ্ধ হয়ে একে অপরের পিঠ চাপড়ায় তাদের দলে জোর করে ঢুকতে যাবেন না। তবে আর আপনাকে ইগনোরড হবার যন্ত্রনা সইতে হবে না।সংস্কৃতি করার এটা দ্বীতিয় টিপস। 

টিপস ১৩
মানুষকে বিশ্বাস করুন। বিশেষত সহায়ককে শত্রু ভাববেন না। ভালোবাসুন প্রাণ দিয়ে। কিন্তু মনে রাখবেন অর্ডার আপনাকে দিতে জানতে হবে, তবে তার সফট পদ্ধতি খুঁজে বের করুন। 

টিপস ১৪ 
নিজেকে সর্বজ্ঞ প্রমাণ করতে অন্যের খুঁত ধরবেন না।

টিপস ১৫ 
অন্যকে বদলানোর চেষ্টা করবেন না, কারণ আপনি বদলে তার মতো হবেন না।

টিপস ১৬
অন্যকে উপহার দিন মাঝে মাঝে। খুব ভালো লাগে। অন্যকেউ উপহার দিলে খুশি মনে নিন। তবে দেখবেন কোনও উপহার বোঝার মত ঘাড়ে চেপে বিসলে রিফিউজ করুন।
টিপস ১৭
সমস্ত দিক বালান্স করার চেষ্টা করবেন না উলটো ফল পাবেন
টিপস ১৮
কেউ যদি বলে একটা কথা বলব কাউকে বলবি না, প্রথমেই বলে দেবেন বলে ফেলতেও পারি। তাতে যদি কথাটা না শোনা হয় শেষ পর্যন্ত, তবুও আগ্রহে বুক ফাটিয়ে ফেলবেন না। কারণ আপনি না বললেও অন্য কেউ বললে সন্দেহের তীর থেকে আপনি বাঁচবেন না।
টিপস ১৯
অন্যের সামনে দাঁত, নাক খুঁটবেন না, থুতু ফেলবেন, ঢেকুর তুলবেন না, বাতকম্ম করবেন না, মাক্সি পরে ফেসবুকে ছবি দেবেন না। এর কথা ওকে লাগাবেন না।
টিপস ২০
নিয়মিত পুকুরঘাটে আসুন। এখানে,বোকা, অহঙ্কারী, ন্যাকা, ধান্দাবাজ, অতি চালাক এবং গোষ্ঠীবদ্ধদের চিনতে পারলেও প্রকাশ্যে গালি দেবেন না।

যৌনতার ধারণা জরুরি


আমাদের দেশ কনসেন্টের দেশ। কতটা খাবো, কতটা ঘুমোব, কতটা সাজব, কি কথা বলব এমন কি কার সঙ্গে এবং কবে থেকে যৌনতায় লিপ্ত হবে এসবই ঠিক করে দেন অভিভাবকরা। সচেতন পরিবারগুলি ছেলেমেয়েদের দাঁত মাজতে, নখ কাটতে, হাত ধুতে, বড়দের সম্মান করতে শেখান অথচ যৌনশিক্ষা তাঁরা দেন না। ফলত বহু ধেড়ে বয়েস পর্যন্ত অধিকাংশ যৌন আচরণ সম্পর্কে ছেলে  মেয়েরা থাকে অজ্ঞ এবং যেটুকু তারা বন্ধুবান্ধবদের থেকে এবং ইদানিং ইন্টারনেট থেকে শেখে তার অনেকটাই ভুল। আমার অবাক লাগে যখন একটি মেয়ে গল্প করে করে 'ক্লাস নাইনে যখন  আমার পিরিয়ডস হয় আগে জানতামই ব্যাপারটা কি, আমি না জানো ভয় পেয়ে গেছিলাম কি প্রচন্ড', তখন মেয়েটিকে ন্যাকা না ভেবে ইচ্ছে হয় তার বাবা মাকে মুর্খ ভাবতে। আমার এক বান্ধবীর ক্লাশ টুয়েলভে বিয়ে হয়েছিল সে যখন বলে বিয়ের আগে জানতাম চুমু খেলেই বাচ্ছা হয়ে যায় তখন ভাবি ওর বাবা মা কি ওকে বলি দেবার জন্যই জন্ম দিয়েছিল! বিয়ের আগে সামান্য শিক্ষাটুকুও দিয়ে দেয়নি। অথচ একটি কিশোরী মেয়েকে সোজা তুলে দিল লাইসেন্সড বিছানায়। আর সেই মেয়েই যখন তার ক্লাস টেনে পড়া কিশোরী কন্যা 'বাচ্ছা কি করে হয় জানে না এতো সরল' বলে বুক ফুলিয়ে গল্প করে তখন ভাবি হায়রে এই ন্যাকামি আর মুর্খামি কতদিন চলবে। এদের কে বাঁচাবে কামুকদের হাত থেকে। জানি প্রচন্ড যৌন শিক্ষা থাকলেও ধর্ষকরা, কামুকরা নির্মূল হয়ে যাবে না দেশ থেকে। তবু একটা মেয়ের অবাঞ্চিত স্পর্শটুকু বা যৌন ইঙ্গিতটুকু বোঝবার বুদ্ধি তো হবে। এই মি টুর ঝড়ে যে সমস্ত কামুকরা চিহ্নিত হয়েছেন তাদের কারও সঙ্গে কর্মসূত্রে বা কোনও রকমের পরিচয় থাকলে আপনি নিশ্চয়ই  বুঝতে পেরেছেন এঁরা কেউ সাধু পুরুষ নয়, সামান্য সময়েই সেটার একটা ধারণা পাওয়া যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে । অথচ এদের খপ্পরে পড়ছে অজস্র, শৈশব, কৈশোর, যৌবন। যৌন ক্ষুদা এবং  বিকার লুকিয়ে রাখা খুব শক্ত। কিন্তু যে সমস্ত মেয়েরা প্রতারিত, নিপীড়িত হয়েছেন তাঁরা সে ইঙ্গিতটুকু ধরার মত পরিনত হননি এটা আমাদের শিক্ষার দুর্ভাগ্য এবং অভিভাবকদের অজ্ঞতা। আর মেয়েদের নিয়ন্ত্রিত থাকতে থাকতে না বলার শক্তি তৈরি না হওয়ার ফল। সদ্য ঘেরাটোপ মুক্ত মেয়েরা দ্রুত পৃথিবী জয় করতে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ছেন কারণ আবারও বলি যৌন ইঙ্গিত না বোঝার অজ্ঞতা।
তবে এটা আশার কথা মেয়েরা যৌন নিপীড়ন  নিয়ে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার হয়ে উঠতে পারছে। যৌন নিপীড়ন পুরুষদেরও হয়। বিশেষত পেডোফেলিকদের বাছাই তালিকায় বাচ্ছা ছেলেরা প্রায়শই থাকে। আর এটাও জেনে রাখবেন পুরুষদের দ্বারা পুরুষদের যৌন নিপীড়ন ঘটে অনেক বেশি। কিন্তু কজন পুরুষ সে ক্ষেত্রে হ্যাশ ট্যাগ মি টু দিয়ে সে কথা জানাচ্ছেন? উল্টে প্রগতিশীল পুরুষেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বোনি আমি তোমার সঙ্গে আছি বলে রঙ্গ করছেন আর আবডালের আসরে গপ্প করছেন এতোদিন এই মেয়েরা কি করছিলো, এতোদিন বলেনি কেন?  আরে তবু তো এতোদিনে বলে উঠতে পারছে মেয়েরা আপনারা তো এখনো নিশ্চুপ। উলটে বাড়ির মেয়েরা যখন তাঁর হেনস্থার কথা জানাচ্ছেন পরামর্শ দিচ্ছেন চেপে যেতে। অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ আর পৌরুষ আলাদা, কিন্তু পুরুষ আর কাপুরুষে খুব ফারাক করতে পারবেন না।
মেয়েরা প্রকাশ্যে বলার সাহস যেমন অর্জন করেছে না বলার শিক্ষাও অর্জন করুক। কামুক পুরুষ নিজেকে খুব বেশি লুকিয়ে রাখতে পারে না। সামান্য ইঙ্গিতকে হালকা চালে নিয়ে যদি ভাবেন এইখানেই থেমে যাবে ভুল ভাবছেন। আপনি মা হলে সন্তানকে প্রথম থেকে যৌন শিক্ষা দিন। শিশুকে স্পর্শ এবং কিশোরীকে যৌন ইঙ্গিত ও আচরণও বোঝান। অনভিপ্রেত  বলপ্রয়োগ, আচমকা  ধর্ষন এসব ধর্ষকের মৃত্যু ভয় ছাড়া বন্ধ হবার উপায় আমি জানি না। তবে এটা বলতে পারি অপরাধী চিহ্নিত হতে ভয় পায়। তবে পরিকল্পিত অসভ্যতা বা ট্রাপে পড়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব। মেয়েদের না বলার শক্তি অর্জন করতে হবে। আর নিজেকে অপবিত্র,  দোষী ভাবা বন্ধ করতে হবে,  যৌন বিকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন।শোস্যাল প্লাটফর্ম সে জায়গা নয়। প্রতিবাদের সঠিক ভাষা খুঁজে বের করতে হবে একজোট হয়ে। সে ভাষা,এখনও অনাবিষ্কৃত।  যদি বাড়ির লোক বলেন যা হয়েছে চেপে যাও শুনবেন না। চেপে গেলে বারেবারে মুখোমুখি হতে হবে বিকৃতের। 

আমি জানি এ জগতে এমন মানুষও আছেন যাদের অক্ষরেও কাম জেগে ওঠে। এই লেখার সামান্য নিরিহ কতগুলি শব্দও তাদের উত্তেজিত করতে পারে, এইসব ভেবে আমি লিখিনা কখনও, ইচ্ছে হয়না। আর সোশ্যাল মিডিয়ার হঠাৎ প্রতিবাদে গা ভাসানোতেও আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে 'প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ আর চুপ নয় আর।
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায় (২৪.১০.১৯)
নিজের যা মনে হয়

টিপ্স

#টিপস
আমি এ জীবনে সেই অর্থে সংসারী হয়ে উঠতে পারিনি। মা, শাশুড়ি,  জেঠিমা, মাসি আর মিনতি দি, মিতালিদিরা আমার জীবনটাকে এ যাবৎ চালিয়ে দিয়েছে। না করেছি রান্না-বান্না, না গুছিয়েছি ঘর, আমি ছন্নছাড়া আগোছালো তাই বই পত্তর, জামা কাপড় কিছুই লোকের সাহায্য ছাড়া তেমন গুছিয়ে গাছিয়ে রাখতে পারিনা। অর্থ বা গতর দিয়ে সংসার চালানোর দ্বায়িত্বও তেমন নেই। তাই সাংসারিক টিপস আমার তেমন জানাও নেই, দিতেও পারিনা। সম্পর্কগুলোও আমার সবই নিজের নিয়মে দিব্য ঠিকঠাক। বাড়ি, মামারবাড়ি শ্বশুরবাড়ি, এমনকি দিদি জামাইবাবুর কাছেও আহ্লাদী গোল্লাদি হয়ে জীবন কেটে গেলো।  তাই টিপস যখন বিষয় দিলাম হাজার মাথা চুলকেও নিজে কি লিখব   ভেবে পেলাম না। আত্মপ্রেমে মজে থাকো আজীবন এছাড়া আর কি'বা বলি! সমাজ, সংসার সব কিছু থেকে গা বাঁচানো মানুষরা টিপস দিতে পারে কি? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তবে কাল কিছু টিপস দেবো লোকের থেকে জেনে, আর যদি না হয় তবে আপনারা লিখুন আমি মনের সুখে কমেন্ট করব।

সেই সব স্মৃতি

নানা রকম বিলাসী ঘর থাকে। যেমন কিছু বিলাসী ঘরে কোনও আড়ম্বর থাকে না। সেই সব ঘরের মালকিনরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম. এ পাশ করেও অথবা না করে লেডিব্রেবোন ডিপ্লোমা নেয় অথবা জোগাড় করে টেক্সটাইল কলেজের সার্টিফিকেট। এরা চোদ্দ,চব্বিশ অথবা চুয়াল্লিশ বছর আগে  দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে ঢোকার পর থেকেই  নতুন  ঘরকে বিলাসী বানাতে তৎপর হয়। নিজে হাতে পর্দায় ফেব্রিক করে। টেবিল ক্লথের কোণে কাশ্মীরি স্টিচ দিয়ে রঙ্গন ফুলের ঝাড় আঁকে, সাবেকি টিপটের জন্য কুরুশের টিকোজি বোনে, পড়ে থাকা বাঁশের টুকরোকে কুঁদে কুঁদে ফুলদানি বানায়, তাতে বেঁচে যাওয়া সাদা,নীল ফেব্রিক কালার দিয়ে নকশা কাটে। নারকেলের মালা দিয়ে অ্যাশট্রে বানায়। মেমসাহেব পুতুল কেনে মেলা থেকে, তারপর সে পাতি পুতুলকে ভাঙা বোতাম দিয়ে রেড ইন্ডিয়ান সুন্দরী বানায়। এইসব মালকীনদের শাড়ি গয়নার চেয়েও বেশি সাধ থাকে ভালো পোর্সেলিনের ডিশের আর ফুলতোলা হ্যান্ডমেড বেডকভারের। পড়ে থাকা  হরিণঘাটার শিশিতে মানিপ্ল্যাণ্ট লাগিয়ে এরা ঘরকে স্বর্গের বাগান বানাতে পারে। টিনের পাউডার কৌটো ফুটো করে এরা পয়সা জমায় আর  বেড়াতে গেলে তা দিয়ে  রাজস্থানি ওয়াল হ্যাংগিন কেনে। এইসব  বাড়ির মালিকরা বৌকে ভালোবাসে খুব, তাই মালকিনদের অভিযোগের সুযোগ থাকেনা। কেবল একটাই অভিযোগ ’ডিভানের কুশনগুলোকে দু ভাঁজ করে মাথার তলায় দিয়ে শুয়ে পড়ে ফাটিয়ে তুলো বের করে দাও কেন তুমি' অথবা ’লোক এলে কেন ঘর সাজাতে দেবেনা বলতো' ঘরের মালিক বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে কেবল উত্তর দেয় 'তুমি যেমন থাকো তেমন করে তোমায় কেউ পছন্দ না করলে সে অতিথিকে দ্বিতীয়বার ডেকোনা' এই সব মালকিনরা তাতে ঘ্যান ঘ্যান করে। 
তারপর কে কার ওপর বেশি রাগ করে  কাকপক্ষীতেও টের পায় না। কিন্তু ঘরে সুচিত্রার গান আর আমজাদের শরদের যুগলবন্দী বাজলে বোঝা যায় মান ভেঙেছে। এইসব ঘরগুলো গরমে খুব ঠান্ডা থাকে আর ঠান্ডায় ওম দেয়। ঘরের দেওয়ালের ডিস্টেমপার কালার হয় মাঝারি মানের কিন্তু স্নিগ্ধ, মেঝে হয়  লাল রঙের। এই সব ঘরগুলোতে গাদা গাদা বই থাকে। তাতে রুপোলী লেজওয়ালা বইয়ের পোকা হলে নিমের পাতা গোঁজে মালকিন। রিটায়ারমেন্টের পর মালিক মালকিন মুখোমুখি বসে বই পড়ে পাকদন্ডী আর ইউলিসিস। এই সব বিলাসী ঘরের রকম মোটামুটি এমনই হয়। 
একদিন সেই সব ঘরেরই একটা চেয়ার কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। ফুলদানি শূন্য পড়ে থাকে, ডিভানের চাদর কুঁচকে থাকে। জানলায় ঝোলে বাজারের মোটা পর্দা, দেওয়ালের ছবিগুলো ঈষৎ বেঁকে ঝুলতে থাকে। কুশন আর কাউকে মুড়ে ফাটিয়ে দিতে হয়না। কালের নিয়মেই মুড়ে যায়। সেন্টার টেবিলে পড়ে থাকে আধ খাওয়া জলের বোতল। মালকিন একবুক অভিমান নিয়ে বসে থাকে বিলাসের স্মৃতি মাখা সোফায় আর মালিক ছবি হয় ঝোলে। সুচিত্রা মিত্র আর আমজাদের যুগলবন্দীর ক্যাসেট আর বাজেনা। কবেই ফিঁতে জড়িয়ে গেছে।

নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০.১০.১৯
পুরোটাই ব্যক্তিগত [প্রকাশিত]

প্রাতরাশ

#জলখাবার
একমাত্র ধীর স্বভাব আর চেহারার গড়ণ ব্যাতিরেকে মেয়ে মানুষের সমস্ত গুণ বর্জন করিয়া জন্মাইয়াছিলাম আমি। জন্ম ইস্তক  এই সমস্ত শুনিয়া আমিও তাহা বিশ্বাস করি মনেপ্রাণে। ঘর গুছাইয়া রাখা, সূচীকর্ম, রন্ধন কিছুতেই আমার দক্ষতা নাই। এ জন্য অবিশ্যি কখনও আমাকে গঞ্জনা শুনিতে হয় নাই বরং সকলে বলিয়াছে আহা ও পারিবেনা আমি করিয়া দিতেছি। দিদি, মা, জেঠি, সশ্রুমাতা, বন্ধু, বোন সহায়িকা, এমনকি স্বামীও আমার মধ্য বয়সেও আমাকে এসব ক্ষেত্রে শিশুর মত প্রশ্রয় দিইয়া থাকে। বাটিতে বাটিতে, মুখে মুখে জোগান দিয়া। আমি বস্ত্রের স্তুপ, বর্তনের স্তুপ, বইয়ের স্তুপ, ধূলার স্তুপ দেখিলে আকূল পাথারে পড়ি। পেটিকায় সমস্ত কিছু কলসের মত গুঁজিয়া রাখিয়া আমার গৃহী না হইবার সুনাম বর্ধন করি। তার উপর সন্তানাদি নাই। প্রতিবেশী থেকে আত্মীয় সকলে বলিয়াই দেয় 'তোর আর কি অসুবিধে 'ট্যাঁ ফ্যাঁ তো নেই, কোনও কাজ নেই' সত্যই আমার অসুবিধা নাই। কিন্তু উহাদের কে যে এতো অসুবিধা করিয়া ট্যাঁ ফ্যাঁ আমদানি করিতে বলিয়াছে জানা নাই। যাই হোক শিবের ভজন করিয়া লাভ নাই। যে প্রসঙ্গে এই ভূমিকা, সংসারে আমার ইদানিং একটি মাত্র দ্বায়িত্ব অর্পিত হইয়াছে প্রাতরাশ প্রস্তুত। সেই কাজ করিতে রন্ধনশালায় ঢুকিয়া এতো কেশ কর্ষণ করিয়া থাকি মস্তকে কেশাভাব  দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন । আমার সশ্রুমাতা আমার অবস্থা অনুধাবন করিয়া বলেন 'ছাড়তো ছেলেদের খালি নোলা আমায় ওটস দিয়ে ওদের পাঁউরুটি দিয়ে দাও’ শ্বশুরমহাশয় কিছুই বলেন না, আর উহাদের পুত্র বলেন 'আমি কী কখনও কিছু ডিমান্ড করেছি, যা হোক দিলেই হবে' সত্য এদের চাহিদা নাই কোনও অভিযোগও নাই। কিন্তু উহাদের মুখ দেখিয়া বুঝি ভিতরের যন্ত্রনা। তাই আমি মধ্যে মধ্যে উপমা, ডালিয়ার খিচুড়ি,  সান্ডউইচ, পরোটা সাদা আলুর তরকারি, ফ্রেঞ্চফ্রাই, দু একবার লুচি, স্ক্রাম্বেল্ড এগ, চিঁড়ের পোলাউ,এক দু বার রুটি সাধ্য মতো বানাইতে চেষ্টা করি। কি যে হইয়া উঠিল বুঝিতে পারিনা। জিজ্ঞাসা করি কেমন বানাইলাম উহারা সকলেই কহেন খুব ভালো। কিন্তু মনে মনে অবাক হন এই নিত্য কর্মে আবার এতো জানিবার কি আছে। কিন্তু গোপনে বলি যখন কোনও অনিত্য অতিথি আসিয়া বলে আপনার রন্ধন অপূর্ব, চোখ থেকে মুক্তা গড়াইয়া পড়ে অলক্ষ্যে । লোকে যতই ভাবুক আমি এই আগোছালো থাকা আর সাংসারিক অপটুত্বকে উপভোগ করি আমার মন জানে ইহা সর্বৈব মিথ্যা। কিন্তু খঞ্জের কী আর এভারেস্ট বিজয় হয়?

Saturday, 9 November 2019

ঘরেলু

যাদবপুর এইট বি তে সেদিন দেখা হলো মেয়েটির সঙ্গে। নীলা কেমন আছো বলে নিজেই এগিয়ে এলো। আগে হলে চিনতে পারতাম না এখন ফেসবুকের দৌলতে প্রায়ই মেয়েটিকে দেখি। আমার সহপাঠী ছিল কিনা মনে নেই। এক বছর ওপর বা নিচেও পড়তে পারে। ওকে মনে আছে কারণ ওর প্রেমিক আর আমার একই বিভাগ ছিল। ছেলেটির কথা মনে পড়ায় বললাম অমুক কেমন আছে। মেয়েটি জবাব দেয় আমাদের যোগাযোগ নেই বহু বছর। অপ্রস্তুত হই। ও আমাকে নানা প্রশ্ন করছিল আমি পালটা কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল মেয়েটি কবিতা লিখত। জানতে চাইলুম লেখালিখি করছ? মেয়েটি জবাবে বলে 'ধুস কবিতার পাঠক কই। লিখেটিখে খালি শান্তি নষ্ট।' আমি জানতে চাই 'শান্তি নষ্ট কেনো!' মেয়েটি বলে 'কজন প্রতিষ্ঠিত মেয়ে লেখক, শিল্পীর একটা করে বিয়ে দেখেছ?' আমার মুখের এক্সপ্রেশন কেমন ছিল কেজানে মেয়েটি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে 'jokes apart, মজা করছিলাম, এই তুমি না আমার বরকে চেন।' নামটা শুনে বুঝলুম আমি কেনো অনেকেই চেনে। আমি কম বলছিলাম মেয়েটি ইউনিভার্সিটির দিকে দেখিয়ে নানা স্মৃতি রোমন্থন করছিল। আর আমি ওকে দেখছিলাম, সাদা হ্যান্ডলুমের শাড়ি, বোট নেক ব্লাউজ, রূপলি গয়না, নাকে সিলভার নোসপিন। আর বাঁ হাতে প্রকান্ড সোনা বাঁধানো পলার আংটি। মেয়েটি বলে 'তখন থেকে আমার আংটিটা দেখছ কেনো গো? আমি এসব মানি না। আমার মা মানে এসব, মাকে না করতে পারি না। কষ্ট পাবে। আসলে আমার বর খুব ভালো মানুষ। আমি না খোঁচালে কোনো রাগটাগ নেই। ওর কেবল একটাই অভিযোগ আমি একদম তোমাদের মত সংসারী নই। তাই এসব মা দেয়। যদি ঠিকঠাক হইএকটু,  ঘরেলু টাইপ'। আমি ওকে আশ্বস্ত করি 'আরে না আমি এসব দেখিনি।' আমার বাস এসে যাওয়ায় আমি ওকে বিদায় জানাই। বাসে উঠে  বাসের আয়নায় দেখি আমার পেছনে লাইন দিয়ে বসে আছে আমাদের মতো  সংসারী মেয়েরা। তাদের সকলের হাতে আংটি। এমনকি আমার অনামিকাও ফাঁকা নেই।

অনিকেত

অনিকেত

এসি বাসখানা দুর্বার গতিতে ছুটছিল রেড রোডের ওপর দিয়ে। শীতের দুপুরের মিঠে রোদ ঠিকরে আসছিল আমার ডান কপালের ওপরে। নাকে আসছিল একটা মৃদু সুবাস। বোধহয় পাশে বসা অবাঙালি সহযাত্রিনীর গায়ের সুগন্ধি। ঘাড় ফিরিয়ে আঘ্রাণ নিতেই অল্প হাসলেন, প্রত্যুত্তরে আমিও হাসলাম, ওই অল্পই। খানিক আগেই ফেলে এসেছি  গাঢ় কমলা রঙের লেবু, মস্ত মস্ত আকারের চকচকে সবুজ বোম্বাই কুল, একরাশ বেলুন, রঙবেরঙরে সোয়েটার, কলকল করে কথা বলে যাওয়া এক ঝাঁক ছেলে-মেয়ে, গড়ের মাঠের ক্রিকেট প্রাক্টিস ,ময়দানের তাঁবু! শীতের কলকাতার রূপ যেন ঝরে ঝরে পড়ছিল সেদিন। পাশে বসা ভদ্রমহিলার বোধহয় কড়া এসিতে দিন রাত কাটানোর অভ্যেস, দেখলুম এই শীতের দুপুরেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গায়ের নরম শাল খুলে কোলের ওপর রেখে আমায় বললেন ‘আসলে গাড়ি আচানক খারাব হয়ে গেলো রাস্তায়, ড্রাইভার এই বাসডাতে তুলে দিলো।‘ আমি উত্তরে কেবল হাসলুম দেখে, নিজেই বললেন ‘আলিপুর নেবে যাবো, আপ?’ বললুম বেহালা। ‘আপনার বেগটাতো খুব সুন্দর! কুথা থেকে নিলেন?’ এইবারে একটু জোরের সঙ্গেই বললুম এখানকার ব্যাগ নয় এটা। USA থেকে আনা। সহযাত্রিনী কথার সমর্থনে বললেন ‘দেখেই বুঝেছি, আমার সেম বেগ আছে, দুবাই থেকে লিয়েছিলাম।‘ আমি উত্তর দেবার আগেই বললেন ‘এ দিকটায় বড্ড ভিড় আছে, আমার মাহকার কছে এতটা ভিড় নেই’ আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে বললেন ‘লাউডন স্ট্রিট’।আমি বললুম হ্যাঁ আমিওতো ফাঁকায় ফাঁকায় বড় হয়েছি, বড্ড হাঁফ ধরে। ভদ্রমহিলা উৎসাহিত হয়ে বললেন ‘আপনিও! ওই দিগটা এখনো  অনেক ভালো আছে বলুন। সব কেমন কাছে। কুথাও যাবার ঝামেলা কম!’
 শীতের কলকাতা আশ্চর্য ম্যাজিক জানে বটে! আজন্মকাল সিঙ্গুর, হুগলিতে বেড়ে ওঠা আমাকে একটা এসি বাস, একটা ইম্পোটেড ঘড়ি আর ব্যাগ অনায়াসে বানিয়ে দিলো রডন স্ট্রিট অথবা লাউডন স্ট্রিটের বাসিন্দা। মনে মনে গান ভাঁজছিলুম ভুতের রাজা দিলো বর... আবার প্রশ্ন ‘আপনার নাম কি আছে? ম্যারেড?’ নাহ আর কথা বলা যাবে না। বাস দ্রুত এগোচ্ছে। মিস করে যাবো শীতের কলকাতাকে। তাছাড়া বেশি বকলে কমে যেতে পারে ব্যাগের মহিমা। না শোনার ভান করে তাকিয়ে রইলুম বাইরের দিকে। পিজির এদিকটাকে মনে হয় হসপিটাল রোড বলে! বেশ আভিজাত্য আছে রাস্তাগুলোয়। ভাগ্যিস সম্পর্কসূত্রে ঠিকানা বদলে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছি। ঝকঝকে কলকাতাকে উপভোগ করতে করতে কেন যে  সীমাবদ্ধ ছবির ডায়ালগ মনে এলো কে জানে, “ রাস্তাঘাট দেখলে বোঝা যায় এখানে এতো লোক মরটরে!” এই সময় এই সংলাপ মনে পড়ে কারও,  দিনকে দিন সিনিক হয়ে উঠছি আমি, দিব্যতো আছে বাপু সবকিছু! হঠাৎ গেটের কাছে মৃদু গুঞ্জন হতে তাকালুম । দেখলুম পায়ে প্লাস্টিকের চটি আর সামান্য মলিণ ডোরাকাটা শার্ট পরা এক ভদ্রলোককে কন্ডাক্টর বলছেন ‘উঠলেই পঁচিশ টাকা ভাড়া, দিতে পারবে তো’ ভদ্রলোক মৃদু স্বরে বললে ‘ও বাবা এতো!” পকেট থেকে মানিপার্স বের করে এগিয়ে দিলেন একটি একশ টাকার নোট। “আর নেই, একটা দশ টাকা আছে।‘’  জানি এবার বিতন্ডা চলবে। অস্বস্তি কাটাতে জানলার বাইরে চোখ দিলুম।  ওমা!আলিপুর জেলের দেখি রঙ বদলেছে, লাল থেকে নীল। ততক্ষণে বাইরের ঝকঝকে রোদটা একটু ম্লান হয়েছে। আমার কপালে আর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। বাস খানিক এগোতেই দেখলুম অভিজাত রাস্তাগুলো ক্রমশ কেমন মধ্যবিত্ত হচ্ছে। দেখলুম এক বৃদ্ধ এক পাঁজা ডেচকি নিয়ে মাজতে বসেছেন রাস্তার কলে। শীতে না বয়েসের ভারে জানি না, ওঁর উদোম পিঠের চামড়াটা কেমন তিরতির করে কাঁপছে। চোখ ফিরিয়ে নিতেই নাকে এলো সেই মৃদু সুবাস। জানতে চাইব ফরাসি সুগন্ধি কি না, থাক। আমার গায়েও লাগানো আছে ডিউটি ফ্রি থেকে কেনা আডিডাস আক্যোয়া, কম কি। আবার বাইরে দিকে তাকাতেই দেখলাম সুদর্শন ট্রাফিক সার্জেন্ট বাইকের কাছে হাত নিচু করে কুড়ি টাকা নিয়ে পকেটে পুরলেন। চায়ের দোকানের পাশে ঘুপচি গলিতে এক কিশোরের প্যান্ট টেনে খুলে দিচ্ছে একটা লুঙ্গি পরা লোক, ছেলেটি লজ্জায় ত্রাহি ত্রাহি চেঁচাচ্ছে  আর লোকটা লাল ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসছে। লালবাতির মুখে বাস দাঁড়িয়ে গেলে দেখলুম কমলা লেবুর ঝুড়ি নিয়ে রাস্তা পেরনো এক বৃদ্ধাকে কোনও নিয়ম না মানা একটা অটো ধাক্কা দিয়ে ছুটে চলেছে। আর ছিটকে পড়া বুড়ির ফুটপাতে মাথাখানা লেগে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। রাস্তায় ছিটিয়ে থাকা কমলা লেবুর ওপর দিয়ে এগিয়ে গেলো আমাদের বাস। হয়তো লেবুগুলোকে চাকার তলায় পিষে তারপর এগোল। 
হঠাত করে শীতের কলকাতা এমন হিম শীতল হয়ে গেলো কেনো! এসি কি খুব জোরে চলছে? বাইরেটাও কেমন ঝাপসা হয়ে এলো, আমার চশমার কাঁচে কি বাষ্প জমলো? নাকি বাসের জানলায়। ভাবলুম জানতে চাই ভদ্রমহিলার কাছে। চেয়ে দেখলুম পাশে বসা ভদ্রমহিলার তখন উঠি উঠি সময় হয়েছে। আমার কেনো যেন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল নাম জানতে চেয়েছিলেন না? আমি না কলকাতার কেউ নই। আমি সিঙ্গুরের নীলা। তারপর মনে হল এখন যখন বাপের বাড়ি যাই দেখি একটু আগে দেখা মানুষরাই  ভিড় করে আছে সেখানে, কেবল নাম ঠিকানা বদল হয়েছে। ভদ্রমহিলা নেমে যাবার জন্য সিট থেকে উঠলেন। আমার দিকে চেয়ে বললেন চলি। আমি দু পলক চেয়ে বললাম আপনি নাম জানতে চেয়েছিলেন না? আমার নাম অনিকেত। ‘বহত খুবসুরত’। ভদ্রমহিলা দ্রুত এগোচ্ছিলেন দরজার দিকে। চিৎকার করে জানতে চাইলাম অনিকেত মানে জানেন। ঘাড় ফিরিয়ে বললেন ‘নেহি’। অনিকেত মানে যার কোনও বাসা নেই। আলিপুর থেকে বেহালা আর কতক্ষণ কে জানে, বড্ড শীত করছে যে।

আদিখ্যেতা বন্ধ হোক

#আদিখ্যেতা_বন্ধ_হোক 
আমি ইংরেজি বুঝিনা অথবা জানি না একথা সোচ্চারে বলা আর উলঙ্গ হয়ে সর্বসমক্ষে ঘুরে বেড়ানো  ভারতবাসীর কাছে একই রকম লজ্জার। তেমনি আমি ক্রিকেট,  ফুটবল আর লন টেনিস বুঝিনা বলা আমাদের কাছে সেই একই রকম লজ্জার। কিন্তু কেন! ইংরিজি যেমন আমার ভাষা নয় তেমনই ক্রিকেট,  ফুটবল, টেনিস আমার খেলা নয়। কিছু  বানিয়া এসে তাদের পছন্দ,  তাদের ভালোলাগা, তাদের রুচি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে আর সেটাকেই সযত্নে  আমরা লালন করে চলেছি। যে সমস্ত খেলা আমাদের রক্তের মধ্যে নেই, জিনে নেই তাকে জোর করে অভ্যেস দিয়ে রপ্ত করলে কতখানি হওয়া সম্ভব! যদি বলেন ক্রিকেটের কথা, দুশো বছরের গোলামীর অভ্যেস আর ইংরেজদের কাছে নিজেদের আনুগত্য প্রদর্শনের প্রবল প্রচেষ্টা থেকে আমরা নিরন্তর অভ্যেস করে ক্রিকেট রপ্ত করেছি বটে, কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি ভারতীয় ক্রিকেটকে যদি ফুটবলের মতো বহুদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়তে হত তবে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটে  ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অবস্থাও ভারতীয় ফুটবল টিমের মতই হতো। আমাদের শারীরিক গঠন, আমাদের ইনস্টিংট ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিসের জন্য তৈরিই হয়নি। যেটুকু আমরা করি পুরোটাই অভ্যেস থেকে। 
প্রায় একশ চৌত্রিশ কোটির দেশে স্বাধীনতার পর থেকে উনিশটি অলিম্পিক খেলে ভারতের সোনা প্রাপ্তির সংখ্যা মাত্র নয়টি। এরচেয়ে লজ্জার আর পৃথিবীর দ্বীতিয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশে আর কী হতে পারে। অথচ চীনের কথাই ধরুন গত পাঁচটি অলিম্পিকে তারা কত দ্রুত উঠে আসছে। তা কি কেবল তাদের রেসিডেন্সিয়াল আকাদেমি গুলোতে ছোট থেকে প্রাক্টিসের জন্যই সম্ভব হচ্ছে! সেটা একটা বড় কারণ তো বটেই। তার চেয়েও বড় কথা ওদের সকারের স্বাস্থ্য এবং খেলাধুলো চর্চায় প্রচন্ড গুরুত্ব দেওয়া এবং তার সঙ্গে সেই সমস্ত খেলাগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যা তাদের ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার, ইন্সটিংট, এবং জিন পারমিট করে। সে জন্য সমস্ত খেলায় সাফল্যের সঙ্গে টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, মার্শাল আর্ট, ফেন্সিং ইত্যাদিতে চিনের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। এই খেলাগুলিতে ক্রমাগত সাফল্য তাদের অন্য খেলাগুলিতেও উৎসাহী করে তুলছে এবং এরা প্রচন্ড ডিসিপ্লিন আর চর্চার মধ্যে দিয়ে  সফলও হয়ে উঠছে। সোভিয়েট ইওউনিয়ান থাকা কালীন USSR এর প্রচন্ড সাফল্যের পেছনে কিন্তু ছিল মূলত আক্রোব্যাট,  ওরিয়েন্টেড খেলা গুলি।  জিমন্যাস্টিকস, পোলভোল্ট ইত্যাদির কথা বলা যায়। রাশিয়ার পাশপাশি দেশ রুমানিয়াও তাই ছিল। সের্গেই বুবকা, নাদিয়া কোমনিচি তো তার উজ্বল উদাহরণ। অথবা USA যে এতো সফল  তা কিন্তু ওদের খেলার ধরন অনুসারে খেলোয়ার নির্বাচন দেখলে বোঝা যায়। ট্রাক আন্ড ফিল্ড আথেলেটিক  কেন্দ্রিক খেলাগুলিতে  কিন্তু ওরা বেছে নিচ্ছে ব্ল্যাকদের কারণ ওদের ক্ষিপ্রতা অনেক বেশি, ওদের জিন তেমনি চালনা করে। কার্ল লুইস, জ্যাকি জয়নার কার্সি, ফ্লোরেন্স গ্রিথিফ এঁরা,সকলেই কালো মানুষ। আবার সাঁতারে  সাফল্য পাচ্ছে মাইকেল ফিলিপের মতো  সাদা চামড়ার মানুষ। অস্ট্রেলিয়া,  ব্রিটেন সব জায়গাতেই সাঁতারে সাফল্য পান সাদা মানুষরা। ব্যতিক্রম অবিশ্যই আছে কিন্তু তা ব্যাতিক্রমই।  আমেরিকা যেহেতু বহু জাতির দেশ তাই বিভিন্ন খেলায় বিভিন্ন জিনগত বৈশিষ্ট্যের মানুষ পাওয়া,সহজ।
কিন্তু সে বৈশিষ্ট নিয়ে তো আমাদের দেশও রয়েছে। এখানে মঙ্গল, আর্য, অনার্য এমনকি ব্ল্যাকদের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষও র‍য়েছেন। তবে খেলায় এমন ধারাবাহিক অসাফল্য  কেন আমাদের। তার কারণ সরকারের চরম উদাসীনতা।  খেলার খাতে সরকার যে টাকা বরাদ্দ করেন তার চেয়ে বেশি আমাদের একেকজন মন্ত্রীর বাৎসরিক চুরির পরিমাণ।  আছে খেলার জগতের নিজস্ব পলিটিস্ক। নিজের লোকেদের মুখ দেখে চান্স পাইয়ে দেবার প্রবণতা। এছাড়া যে খেলার প্রশিক্ষণে যত বেশি খরচ  মিডিয়াগুলোর সেই খেলা নিয়ে  তত বেশি নাচানাচি। যে কারণে হিমা দাসের থেকে সানিয়া মির্জার পেছনে নিউজ প্রিন্ট অনেক বেশি খরচ হয়। ভারতের মত বিরাট বাজার ধরার জন্য হাঁ করে বসে আছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি। কাজেই যাকে বাজার খাবে তাকে ক্যাটার করো। বাকিদের পক্ষে দেশে মেডেল আনার সম্ভবনা থাকলেও তারা চুলোয় যাক। 

আপনারা দয়া করে ক্রিকেট,  টেনিস নিয়ে নিরন্তর আদিখ্যেতা বন্ধ করে কুস্তি, তীর ধনুক, কাবাডি ইত্যাদি সমস্ত খেলায় নিজেদের ছড়িয়ে দিন। এসব খেলা আমাদের রক্তে, আমাদের পরম্পরা। আমরা মনোযোগী হলে আম্বানী বিড়লারাও মনোযোগী হবেন। আমরা তাদের বাজার যে। আর আম্বানী, আদানিরা এ সমস্ত খেলায় লগ্নি করলে মোদি, মোনমোহনরা কিছু ভাবতেও পারেন।
#নীলা_বন্দ্যোপাধ্যায়

Thursday, 7 November 2019

সে এক কাল ছিলো

#সে_এক_কাল_ছিল
আমার বাবার বাড়ি  এক্কেবারে গোঁড়া  ঘটি বাউন, আমার মা আমাদের  বাড়ির প্রথম রেজিস্টার্ড বাঙাল। তার আগে বাবার কাকামশাই স্বদেশী করতে গিয়ে বাঙাল মেয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে তাজ্য পুত্র হয়েছিলেন। এ হেন বাড়িতে বাঙালদের রান্না মানেই ছিল লাল লঙ্কার ঝালে ভরা তেল মশলা, পেঁয়াজ, রসুন দেওয়া গরগরে রান্না। যা খেলে সকাল বেলা বাহ্যে যেতে হয় বরপ নিয়ে, এমন কথা ও বাড়িতে হামেশাই শোনা যেত। 
আমাদের একটা খুব পুরনো পেল্লায়  বাড়ি ছিল। তাতে অনেক লোক। সেখানে তিন চার দফায় রান্না হত, জলখাবার, সেই সঙে বাড়ির ছেলেরা আপিস যাবে তাদের ভাত আর দুকুরবেলার রান্না। 
 তাতে আমার ছোটবেলাতেও  দেখেছি আমাদের যে হেঁশেল ছিল তাতে পরপর বাঁধান উনুন ছিল, (গ্যাস এসে যাবার পরেও), হেঁশেলের পাশেই ছিল খাবার দালান আর তার পাশে ভাঁড়ার ঘর। আমাদের জল আর বাটনা ব্রাহ্মণ বাড়ির লোক ছাড়া কেউ দিতে পারত না। শুনেছি আমার বড় জ্যাঠাইমা মাঝে মাঝেই আলাদা হয়ে গিয়ে ওই হেঁশেলেই রান্না করতেন। তার জন্য আমার বড় জেঠু  বালেশ্বর থেকে রান্নার বামুন নিয়ে আসতেন। কিছুদিন পর মিল হয়ে গেলে সে বামুন সবার রান্না করত। তারপর যে তার কি হত আমার স্পষ্ট মনে নেই। আসলে আজ থেকে বছর পঁচিশ সাতাশ বছর আগেও মফস্বল বা গাঁ গঞ্জের  অনেক ঘটি বাড়ির চেহারাই  উনিশ শতকের ঘটি বাড়ির চেয়ে খুব বেশি বদলায়নি। 
 আমাদের ওই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কুলদেবতা ছিলেন শ্রীধরদেব। আমরা হাফ বৈষ্ণব, কারণ বাড়িতে দুর্গা দালানে পুজোও হতো। কিন্ত আমাদের বাড়ি মাংস, ডিম পেঁয়াজ, রসুন হতো না। আমিষ পদ বলতে একমাত্র মাছ। সপ্তাহে একদিন পুকুর থেকে মাছ ধরা হতো আর বাকিদিন বাড়ির বাবুদের সঙ্গে কোনো কাজের মানুষ বাজার থেকে গিয়ে পেল্লায় পেল্লায় মাছ নিয়ে আসত। বাড়ির খিড়কির যে দরজা তাকে আমাদের বাড়িতে বলত গোরেলা। তা গোরেলার কাছে হাঁড়িতে সারা মাস রাখা থাকত জিওল মাছ। আমাদের ছোটদের জন্য রোজ আর বড়দের পেট খারাপ হলে সেই জিওল মাছ ছিল বরাদ্দ। আর ছিল রোজ রাতে খাবার শেষে দুধ ভাত। বাবা, জ্যাঠারাও খেতেন। মিষ্টি দুধ ভাতের সঙ্গে নোনতা আলুভাতের কম্বিনেশন।  আজও আমার বড় প্রিয়।
আমার মা গল্প করেন মা বিয়ের পর গিয়ে দেখেছেন রান্নাঘরের প্রধান ছিলেন বাবার জ্যাঠাইমা। আমরা বদ্দিদু বলে ডাকতাম। তা বদ্দিদু মাকে বিয়ের পর প্রথম ডেকে বলেছিলেন এই বাঙালের মেয়ে আমি রান্না করব বসে বসে শেখ। তোদের মত ঘাস পাতা এ বাড়িতে চলে না। তো প্রথম দিন মায়ের শিক্ষানবিশি শুরু হতে মা দেখেন বড় দিদু বিরাট লোহার কড়াইয়ে ডাল ফোটাচ্ছেন আর হড়হড় করে জল ঢালচ্ছেন, হঠাৎ  ডালের মধ্যে ঝপাস করে কি পড়ল। ডালের থেকে ছ ইঞ্চি ওপরে পাহাড়ের আকৃতির ভেলিগুড়ের ডেলা। মায়ের চোখের সামনে দুলতে দুলতে সেই ভেলিগুড়ের পাহাড় মিলিয়ে গেল আর মা মনেমনে ভাবছেন পায়েসেও এই পরিমাণ গুড় দেওয়া হয় কিনা সন্দেহ। মা মৃদু প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ধমক খেয়েছিল চুপ কর মাগী,  তোদের বাঙাল বাড়িতে নঙ্কা ছাড়া খেতে জানে নাকি। 
আমাদের বাড়ির পুরুষরা কেউ রুটি, মুড়ি খেতেন না। তাদের প্রতিদিনের জলখাবার ছিল অথবা কারও কারও রাতের খাবার ছিল নক্কি ঘিতে ভাজা নুচি। আমার সেজ জ্যাঠাইমা ছিলেন লুচি পরোটার এক্সপার্ট।  আমিও রুটি বেলতে শিখেছি জেঠিমার কাছে। জেঠিমাদের শেখান হয়েছিল নুচির নেচি হবে ছমাসের বাচ্ছার মুঠির মাপে, আর নুচি বেলতে হবে আড়াই প্যাঁচে।  তা সেই আড়াই প্যাঁচের লক্ষ্মী ঘিয়ের নুচির সঙ্গে থাকত  ক্ষীর। যে পুরুষের যত বেশি রোজকার আর যারা বয়ঃজ্যোষ্ঠ  তাদের ক্ষীর করার জন্য দুধের পো হত তত বেশি। 
আমাদের বাড়িতে বছরে মাঝে মাঝে কালীঘাট থেকে মাংস আসত। সেই মাংসের নিরামিষ ঝোল হতো। আমার মা এখনও মাঝে মাঝে হাজির দোকানের মাংসের নিরামিষ ঝোল করেন। তা কালীঘাটের সেই নিরামিষ মাংস আমাদের পাতে  পড়ত কণামাত্র। কিন্তু তাই আমরা সাপটে খেতুম।সে মাংসের দ্বায়িত্বেও থাকতেন বাবার জ্যাঠাইমা। আমার ছেলেবেলায় খুব অসুখ করেছিল একবার। ডাক্তাররা বাবা মাকে মুরগী খাওয়াতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এদিকে ও বাড়িতে মাংসই হয়না তার ওপর মুরগী।  অগত্যা বাবা চিকেন আম্পুল কিনে আনতেন। আর আমাকে বাড়ির বাইরে মেয়েদের স্নানেরঘাটে গিয়ে তা খাওয়ানো হতো। সেও এক পুকুরঘাটই ছিল বটে। ও বাড়িতে বৃহস্পতিবার ছিল নিরামিষ বাধা। সেদিন পোস্ত আর বিউলির ডাল মাস্ট। আমাদের বাড়িতে সবাই বলত কড়ায়ের ডাল। যেমন চাটনিকে বলত অম্বল, সুক্তোকে বলত শুক্তুনি, মাছের মাখা মাখা ঝোলকে গ্রেভি না বলে কাই বলত।
আমিষ হোক বা নিরামিষ মা বা বাড়ির অন্যান্য মায়ের জায়েদের রান্নার জোগানের কাজ ছিল। কিন্তু রান্না করতে হতো না। মায়ের বড় জা ছিলেন মায়েদের  কুড়ি বছরের বড়। তিনি আবার বিয়েতে যৌতুক হিসেবে  চুনা পাথরের টিলা পেয়েছিলেন আর মিশনারী স্কুলে ক্লাশ নাইন অদ্ধি পড়েছেন তাই জোগাড়ের কাজ করতে তিনি নারাজ। তার ওপরে সৎ শাশুড়ি তাঁর থেকে খুব বেশি বড় নন। কাজেই তোয়াক্কা খুব কাউকে করতেন না। আমার আবছা যেটুকু জ্যঠাইমার চেহারা মনে পড়ে তাতে চোখের সামনে পুরনো বাংলা সিনেমার রাজলক্ষ্মী দেবীর কথা মনে হয়। দিদি বলতে পারবে। ওর হয়ত জ্যাঠাইমাকে আর একটু ভালো মনে আছে। আমার বড় জেঠু ছিলেন খুব বড় টি টেস্টার। তাঁর কাছে প্রায়ই সাহেব সুবোরা আসতেন, তবে কলকাতার ফ্লাটে। একবার এক জার্মান সাহেব আর তার বউ আমাদের সিঙ্গুরের বাড়ি এলেন।  তারা আসবে বলে ভাল কাপ প্লেট, মিল্ক পট,সুগার পট, টিপট, টিকোজি বেরুলো। নিউ মার্কেট থেকে নানান খাবার এলো। জেঠিমা কয়েক ভরি গয়না পড়ে, পাতা কেটে চুল বেঁধে সাজলেন, ইংরিজিতে সাহেবদের ওয়েলকাম করবেন বলে। ও বাবা কোথায় কি, মেমসাহেব এসে যেই আমার বড়জেঠুকে হাগ করলে আর সেই  আমার বড় জ্যাঠাইমা স্ট্রাইক করে বসলেন। নিজে তো এলেনই না ছেলের বউদেরও আসতে দিলেন না। উপরন্তু সমস্ত নিউমার্কেট থেকে আনান খাবার দাবার দেরাজে পুরে চাবি দিয়ে দিলেন। অগত্যা বড় জ্যাঠামশাই মাম্মা মানে ঠাকুমার স্মরণাপন্ন হলেন। ঠাকুমা তাদের বেগুনি, কচুরি,  আলুরদম, আর শ্রীধরদেবের জন্য বাড়ির তৈরি মিষ্টি খাইয়ে মান বাঁচালেন জেঠুর। আর সার্ভ করার দ্বায়িত্ব পড়ল মায়ের। সাহেবরা নাকি দিব্যি চেটপুটে সব খেয়েছিলেন।
 যাই হোক ও বাড়ির রান্নায় ফিরি। মায়ের থেকে শুনেছি ডাল, ভাত, মাছ ছাড়া বাকি রান্নার দ্বায়িত্বে থাকতেন আমার ঠাকুমা। আমরা মাম্মা বলতাম ঠাকুমাকে। আমার ঠাকুমা ছিলেন মায়ের জেঠি শাশুড়ির একেবারে উল্টো।  অসম্ভব পার্সোনালিটি,  শিক্ষিত আর উদার। দারুন ভালো রান্না করতেন। যেমন ঘটি বাড়ির স্পেশালিটি শুক্তুনি, মোচা, আলুরদম, ধোঁকা, ছ্যাঁচড়া, কুমরোর ছক্কা রাঁধতেন তেমনি বাঙালদের কোনও রান্না থেকে সাহেবদের রান্না রপ্ত করে নিতেন ঠাকুমা ঝটপট। ঠাকুমার হাতের রান্না খেতে বাবার ইউনিভার্সিটির কলিগরা প্রায়ই চলে আসতেন আমাদের বাড়ি। এই সেদিনও একজনের সঙ্গে দ্যাখা হতে বলছিলেন সে কথা। 
এই গোঁড়া ঘটি বাড়িতে আমার মায়ের হাত ধরে ধিরে ধিরে বাঙাল রান্না ঢুকছিল সবার অজান্তে। আসলে মায়ের ধীর শান্ত স্বভাবের জন্য মায়ের ওই ঘটি বাড়ির সমস্ত সদস্যদের কাছে মায়ের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আর মায়ের সঙ্গে একই সময় বিয়ে হয়ে এসেছিল মায়ের খুড়তুতো জা আর আমার বড় জ্যাঠার বড় ছেলের বউ, আর তার কিছুদিন পর ছোটছেলের বউ। আর মার থেকে পাঁচ সাত বছরের বড় আমার সেজ জেঠিমা। বেশ পরে আমার ছোটকাকু বাঙাল বিয়ে করে ছিলেন। যাই হোক মায়ের জায়েরা  কেন যেন মাকে খুব ভালোবাসতেন।  ঠাকুমাদের পর মায়েদের হাতে যখন রান্নার ব্যাটন এলো তখন থেকে এ বাড়িতে কচুর লতি, কচুর শাক, থারকোন পাতা বাটা এসব ইন্ট্রডিউসড হতে শুরু করল। মা চাকরি করতেন তাই রবিবারের সমস্ত স্পেশাল রান্না ছিল মায়ের। এখনও আমার সাতাশি বছরের সেজ জেঠুর বাঙাল বৌমার হাতের রান্না ছাড়া মুখে রোচে না।
কিন্তু ওই বাড়িতে আমাদের ছোটদের ছিল ভারি দুঃখ। বন্ধুরা ইশকুলে এসে কেমন মাংস পেঁয়াজের গল্প করত আমাদের সে উপায় ছিল না। তাই হাঁ করে থাকতাম ছুটিতে মামাবাড়ি যাবার জন্য। ওখানে গেলেই দেদার মাংস আর কাঁচা পেঁয়াজ। আমার মামাবাড়ির প্রত্যেকের ছিল অসম্ভব ভালো রান্নার হাত। মাও জেনেটিকালি সেটা পেয়েছেন। দিদিও কিছুটা। আমারটা এখনও পরীক্ষিত নয়। রেয়ারলি করলে লোকে মন্দ বলে না ওই অব্দি। একদিন মামাবাড়ির রান্নার গল্প করব।
আমাদের ছেলেবেলার আর একটা কথা দিয়ে শেষ করি। আমাদের খামারে ধান ঝাড়া হতো।  সেখানে মুনিষরা দুপুরবেলা খেতে বসত আলু পেঁয়াজের তরকারি আর ভাত। একটুখানি তরকারি দিয়ে সাপটে ভাত মেখে খেত। আমি আর আমার খুড়তুতো দুই দিদি প্রায়ই দুপুরবেলা ওদের খাবার সময় হাঁ করে খামারে বসে থাকতুম, যদি দেয়। সাহস করে দেয়নি কখনো। কেবল একবার একজন একটা ডিমকে সুতো দিয়ে চার টুকরো করে নিজের জন্য একটুকরো রেখে আমাদের বাকিটা দিয়েছিল। সে ডিমের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। আমার কৈশরেই আমাদের যৌথ বাড়ি টুকরো হয়ে গেছিল। বাবাদের আগের প্রজন্ম একেএকে চলে গেলেন। মাংস, পেঁয়াজ, ডিম খাওয়া যায় না ইত্যাদি অজুহাত দিয়ে সকলে ওই বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি করে উঠে গেলো। তিনমহলা ওই বাড়িখানায় আমার এক খুড়তুতো কাকু একা পড়ে আছেন। আমরা দু বোন, বাবা, মা আর সেজো জেঠু জেঠিমা একখানা বাড়ি করে উঠে গেলাম। সে বাড়িতেও খাওয়ার ঘটা ছিল খুব। এখন নতুন বাড়িতেও কেউ নেই। বাবা, জেঠিমা চলে গেছেন। আমরা দু বোন বিয়ে হয়ে দুদেশে। কেবল বাড়িটার দু প্রান্তে পড়ে আছেন আমার মা আর সাতাশি বছরের জেঠু। কিন্তু ঘটি বাড়ির খাওয়াত রীতিটি তিনি আজও বজায় রেখেছেন। দেড় লিটার দুধ, ছটা তরকারি, দুটো রসগোল্লা ইত্যাদি তাঁর রোজ চাই। থাকুক ওই টুকু অন্তত থাকুক। 
সামনেই জন্মাষ্টমী। আমি এ লেখা লিখতে লিখতে আমাদের পুরনো বাড়ির দুর্গা দালানে পাত পেতে বসে খাওয়ার দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। নাকে আসছে গাওয়া ঘিয়ের নুচি আর তালের বড়ার গন্ধ। কি জানি এতো ব্যক্তিগত গন্ধ আপনাদের নাকে পৌঁছবে কিনা। জানি না এত ব্যক্তিগত খাওয়ার গল্পে   আপনারা বিরক্ত হলেন কিনা।
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়

আশায় আশায়

#আশায়_আশায়
নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয় আমার। আফগানিস্তান থেকে আলমবাজার সর্বত্র নিজেকে দেখতে পাই ঘুমের মধ্যে। উপায় কী! পা চলে তো পকেট চলে না। পকেট আনা দু আনায় ভরে উঠলে শরীর চলে না অথবা সময় নেই বলে সময় বয়ে যায় বেশ খানিক। অগত্যা যাযাবরের জীবন কাটে এই ফেসবুকে, ইউটিউবে ইনস্টাগ্রামে অথবা গুগুলে।
এই সব সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ালে আপনি সমাজ, সংসার অন্তর সব দেখতে পাবেন। এখানে ঘুরে বেড়ালে বুঝবেন সাম্যের ধারণা কত ভুল অথবা বস্তাপচা। এখন তো হাতে হাতে মোবাইল আর মোবাইলে মোবাইলে ফেসবুক। সবাই ফেসবুকে আছি মানে বালিগঞ্জ আর বনগাঁর বন্ধুত্ব হবে ভাববেন না।  সোনারপুর হয়ত সাউথ সিটির ফ্রেন্ডলিস্টে থাকে কিন্তু তাদের মধ্যে বিস্তর তফাত। এখানে হিন্দু মুসলমান, বাম, বিজেপি, তৃণমূল, ছেলে,মেয়ে,হিজড়ে, কালো, ফর্সা, লম্বা, বেঁটে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত,  এম.এ, বি.এ, ডাক্তার, এঞ্জিনিওর ব্রাহ্মণ, শূদ্র এমন হাজার হাজার ভাগ আছে।  ক্লাস ডিফেরেন্স অতি স্পষ্ট।  উদাহরণ স্বরূপ বলি খুব নাম করা এক মহিলা লেখককে দেখি রোজ ফেসবুকে লেখেন, গান গান, গাছ পালার ছবি দেন, রান্নার ছবি দেন, নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করেন। অসম্ভব সুন্দরী সেই লেখককে আমি রোজ দেখি। আর মনে মনে তাঁর মত বাঁচতে চাই। তা সেই লেখকের অগণিত ভক্ত, তারা তাঁর ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টেই আছেন। মহিলা আক্টিভ হলেই তারা মন্তব্যের ঝড় তোলেন। এতো যে সবাইকে উত্তর দিতে হলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন। তাই মহিলা বেছে বেছে উত্তর দেন, লাইক দেন, লাভ দেন। কাদের বেছে নেন যাঁরা তাঁর ক্লাসের। একই রকম সোশ্যাল স্টেটাস। ধৈর্য অগাধ,  নাহলে দেড়শ মন্তব্যের ভিড়ে ক্রিম অফ সোসাইটি বাছা মুখের কথা নয়। আমার আগে ভারি রাগ হত। মনে হত বেশ তোমার সবাইকে উত্তর দেওয়ার দরকার নেই,  সব মন্তব্যের প্রতিমন্তব্য হয়ও না, কিন্ত একটা চিহ্ন তো আঁকা যায়, কান্না,হাসি,ভালোবাসা, রাগ কতই তো চিহ্ন দেওয়া এখানে। তাই যদি না পারো কাউকে দিও না। আরে বাবা তোমার লেখক বন্ধুর অথবা বড়লোক সুগৃহিনীর রয়্যালটিতে কি জীবন চলবে, চলবে তো এদের জন্য। পরে মনে হয়েছে বেশ করে। অন্তত তাঁর অন্তরটি তো দ্যাখা যায়। মনে মনে ক্লাসলেস বলে গাল দিয়ে আয় গলা জড়াই বলে সোশ্যাল ওয়ার্ক করার চেয়ে এই ভালো।  যে জিনিস ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে তার জন্য কাঙালপনা বাড়ে তিনি জানেন।
এই যে সাজানো  ডিশ, সাজানো  ঘর, সাজানো আমি,  এইটেই কেবল সারসত্য হয়ে ধরা দিক মানুষের কাছে এই তো সকলের কাম্য। সেই তাসের ঘরের বউটিকে মনে পড়ে আজকাল খুব। ভেতরের ফোঁপরা জীবনটুকু আড়াল করার নামই সোশ্যালমিডিয়া। এই সব মিডিয়ামগুলো আসলে ফরাসি পারফিউমের গন্ধ। আপনার বাতকর্মের গন্ধটুকু আড়াল করার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিচ্ছু পাবেন না। 
আমি নিজেও তো নির্লোভ,  নির্মোহ নই। আমার মধ্যেও ছলনা, কপটতা  ভণ্ডামি ঈশ্বর ঠেসে ঠেসে দিয়েছেন। তবু ভাবি মুক্ত হব কোনও দিন সব কিছু থেকে।  তাই কদিন মনকে প্রবোধ দিচ্ছি পুকুরঘাট আসলে বৃহৎ সত্যের সন্ধান আর আমার নিজের দ্যাখাটাই সংকীর্ণ। আশা হারান পাপ এটুকুই একমাত্র সত্য, এই আশা নিয়ে আমি রোজ পুকুরপাড়ে এসে বসি আর আপনাদের ডাকাডাকি করি।

শিক্ষক দিবস

#শিক্ষক_দিবস
খুব মনে আছে একবার ক্লাসে একটি মেয়ে শতাব্দী দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করেছিল শিক্ষক দিবস কেন পালন করতে হয়। কি সুন্দর করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দিদি। দিদির কথা আমরা এমনিই মন দিয়ে, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, সেদিন থেকে মন কেড়ে  নিয়ছিলেন দিদি আমাদের। সেদিন ওই ছিল আমাদের শিক্ষক দিবস পালন। কোনও আড়ম্বর ছিল না। কেক কাটা ছিল না, দিদিদের দামী গিফট দিতে হত না। বড় জোর বোর্ডে এক লাইন লিখে ফুল সাজিয়ে অপেক্ষা করতে হত দিদিমণি, মাস্টার মশাইদের জন্য। তারপর তাঁদের নিজেদের মত করে,শ্রদ্ধা জানানো। 
আমাদের সময় দিদিমণিরা ছিলেন বড় সাদা মাটা সাজের। সাদা কাপড় আর হাত খোঁপা আর পরিস্কার করে ভাঁজ করে পরা শাড়ি। এই সামান্য সাজেই কি অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ছিল ওঁদের। বীথি দি কিই বা করতেন ওই সময় সাজ গোজ কিচ্ছু না, কিন্তু ওঁর জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, গানের গলা, স্নেহ  সব মিলিয়ে মনে হত বড় হলে এমনটাই হবো। যিনি বা যাঁরা আজও আমাদের আইডলমনে মনে পড়ে দীপিকা দির অনবদ্য ইংরিজি ক্লাস।ছায়া দির পড়ানো,  ছায়া দি বা ছানু দি আঙুল কেটে গেছিলো বলে টিফিন বক্স খুলে খাইয়ে দিয়েছিলেন আমায়।  এসব লিখতে গিয়ে চোখের কোল অজান্তেই ভিজে উঠছে আমার। কার কথা ছেড়ে কার কথা বলি,  মাধুরী দি,পূরবী দি, দুই শ্যামলী দি, দুই কবিতা দি, দুই অনুরাধা দি, অনিতা দি,কাবেরী দি, অকালে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া মিষ্টি, শান্ত  কণিকা দি, শান্ত, সৌম্য অল্প বয়েসের হেনা দি, পুস্পিতা দি, রেবা দি, দুই গৌরী দি, কল্যাণী দি, পুতুল দি, রমা দি, নীলিমা দি অথবা স্কুলের ৪২ জন শিক্ষককে দেখেই মনে হতো এর চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা কি কাউকে করা যায় এ জীবনে! আমার ক্লাস ফোর পর্যন্ত যাঁরা পড়িওয়েছেন, বড় আন্টি, ফাল্গুনী আন্টি আজও আমার মণিকোঠায়।আর যাদের কথা আজ বলতেই হয় সবিতা দি আমার প্রথম টিচার শর্মিলা দি আমার প্রথম অঙ্কের  দিদিমণি। আমাদের ইলেভেন টুয়েলভ ছিল কো এডুকেশন, কি জানি মেয়েদের স্কুল থেকে প্রথম আড় ভেঙে ছেলেদের সহজ বন্ধু হতে শিক্ষকরা সাহায্য না করলে আজও আমাদের অটুট বন্ধুত্ব থাকত কিনা। কার নাম বলব আমাদের ইলেভেন, টুয়েলভে শিক্ষকদের বা স্কুল জীবনের শিক্ষকদের অথবা আমার জীবন পাঠের শিক্ষদের, এই ডিজিটাল খাতাও কম মনে হয়।  আলাদা করে  সত্যি বলছি সিঙ্গুরের মত জায়গায় অমন সব দক্ষ চমৎকার শিক্ষরা ছিলেন বলেই আমাদের দুটো স্কুল থেকে এতো কৃতি ছাত্র ছাত্রী বেরিয়েছে। মিডিয়াতে দ্যাখানো যে সিঙ্গুর, তার মতো যে সিঙ্গুরের চেহারা আদৌ নয়,  এখানে লেখা- পড়ার হার অত্যন্ত বেশি, আপনাদের নিরিখে যাঁরা এ জীবনে সবচেয়ে সফল সেই ডাক্তার এঞ্জিনিয়র সিঙ্গুরের ঘরে ঘরে তার জন্য এই সমস্ত শিক্ষদের অবদান যে অনেকখানি। নাহলে এক জেনারেশন আগে বাবা চাষ করতেন ছেলে ইসরো বা আই আই টি তে, অথবা এম ডি, ডি এম ডাক্তার  এ চিত্র সিঙ্গুরে মোটেই  বিরল নয়। তাঁরা শিক্ষকদের অবদান নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না আমি জানি। আমি স্কুলে দিদিমণি, মাস্টারমশাইদের যে ভালোবাসা পেয়েছি তা ভাবলে আজও অবাক হই।
স্কুলের পরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথম সেলিব্রিটি শিক্ষকদের দ্যাখা পেয়েছিলুম। কি জানি আমার সৌভাগ্য কিনা প্রায় সকলেই আমাকে স্কুলের মতই অত্যন্ত ভালোবেসেছেন সেই জন্যি বোধহয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতায় মন্দের স্মৃতি তেমন নেই। পরবর্তী জীবনে আমি যে সমস্ত মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি তাঁরা নিজেরাই একেকটা ইন্সটিটিউশন। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অশোক মুখোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, দত্তাত্রেয় দত্ত,  সুমন চট্ট্যোপাধ্যায় আমার ছাত্র জীবনে এবং কর্ম জীবনে পাওয়া এমন বহু নাম। জানি এমন বহু শিক্ষকের নাম দিলুম না যাঁদের কাছে এ জীবনে ঋণের ভারে আমি নুইয়ে থাকব। 
আর আমার বাবা, মা দুজনেই পেশাগত ভাবে শিক্ষক ছিলেন। মা,স্কুলে পড়াতেন বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে।  আজও  বাবা মার ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে দ্যাখা হলে তাঁদের প্রতি যে সম্মান শ্রদ্ধা দেখি আমার গর্ব হয় যে আমি শিক্ষকের সন্তান। আর বাবা হয়ত আত্মমগ্ন থাকতেন, ডুবে থাকতেন লেখাপড়ায়, তাই সত্যি বাবার কাছে স্কুল-কলেজের পড়া পড়িনি কখনও।  মনে হতো ওরে বাবা এতো নিচু ক্লাসে বাবা কি পড়াবেন।  কিন্তু পরবর্তী জীবনে তাঁর সঙ্গে আড্ডায় যা পড়েছি তা আমার সারা জীবনের পাথেয়। মা পড়িয়েছেন অনেক। মায়ের সব পড়ানো ছেড়ে একটা কথা আজো মনে পড়ে কোনও শিক্ষকের কিছু ভুলের কথা মাকে বলে ছিলাম একদিন। উত্তরে মা বলেছিলেন শিক্ষকের ত্রুটি ধরো না কখনও।  মনে রেখো উনি তোমার চেয়ে, শ্রেষ্ঠ অনেক বেশি জানেন বলেই উনি শিক্ষক আর তুমি ছাত্র। সেই শিক্ষা আমাদের দু বোনেরই আজও পাথেয়। একই কথা আমি দিদিকে ওঁর মেয়েকে বলতে শুনেছি। আর তিন জনের কথা না বললেই নয়। আমার মেজ মামা অঙ্কের মানুষ কিন্তু উনি হলেন জীবন্ত এনসাক্লোপিডিয়া আর আদর্শ শিক্ষক। যাঁর শিক্ষক জীবন নিয়ে আস্ত উপন্যাস হওয়া সম্ভব।  মায়ের বন্ধু সুনীতি দাস   আমাদের বড়মাসি যাঁর মতো শিক্ষাকে সাধনা করতে এ জীবনে খুব কম মানুষকে দেখেছি। প্রকৃত নির্লিপ্তির উদাহরণ আমার কাছে বাবা, ফুল মামা আর বড় মাসি। আমি যে আবেগে বাড়িয়ে বলছি না যাঁরা এদের চেনেন বুঝতে পারবেন। আর  একজনের কথা শেষে বলি  আমার দ্বারা নিপিড়ীত, উদাসীন  এক ভদ্রলোক যাঁকে নিয়ে  আমি গত কয়েক বছর চলছি। তিনি এখন আমার অনেক অজানার ইস্কুল। তিনি সহ এ জীবনে যাঁর থেকে যা যা শিখেছি, বিদ্যা থেকে জীবনপাঠ সমস্ত শিক্ষকদের আমার অন্তরের প্রণাম। এঁরা সকলেই শ্রেষ্ঠ বলে এঁরা শিক্ষক।
অমিত শাহ হঠাৎ করে কেমন বঙ্গ জাগরণ ঘটিয়েছেন সেই নিয়ে হাসাহাসি করতে-করতে
আজ আমি, আমার এক বোন সমা বান্ধবী  আর তার সাড়ে তিন বছরের কন্যা পুপে একটি দোকানে পুজোর জামা কিনতে ঢুকেছিলুম। হিন্দুস্থান পার্কের ওই দোকানটির খদ্দেররা সাধারণত বাঙালি কিন্তু আমি ছাড়া কেউই তারকেশ্বর লোকাল অথবা বনগাঁ লোকালে চড়া মার্কা বাঙালি নন।  যাঁরা শান্তিনিকতনে সখে বাড়ি করে রাখেন তেমন বাঙালি। অথবা যাঁদের বাড়িতে তিনসেট রবীন্দ্ররচনাবলী, বিভূতি,  তারাশঙ্কর থাকে কিন্তু কখনও তা নিয়ে কথা বলেন না বরং কথা বলতে পছন্দ করেন কামু, কাফকা অথবা সিমোন দে বেভেয়র নিয়ে চোস্ত ইংরিজিতে এবং যারা নিচু তলার কর্মচারীদের সঙ্গে হিন্দি বলতে অভ্যস্ত তারাই মূলত কেনেন সে দোকান থেকে। আমার চেহারার একটা সুবিধে আছে বালিগঞ্জ থেকে বৈঁচিগ্রাম সর্বত্রই মনে হয় এ আমাদের লোক হতে হতেও হলো না। বা প্রায় আমাদেরই লোক। এই দোকানিও আমাকে প্রায় তাঁদেরই লোক ধরে নিয়ে গড়্গড় করে ইংরিজিতে কথা বলছিলেন আর কখনও হিন্দিতে। আমি যত বাংলায় জিজ্ঞেস করি উনি উত্তর দেন ইংরিজিতে। অথচ প্রতিটি জামা কাপড় আমাকে প্রচন্ড যত্ন করে দেখাচ্ছিলেন। আমার ভদ্রলোকের যত্নটুকু বেশ লাগছিল। আর মজা লাগছিল এই দেখে যে আমার সেই বান্ধবীর  ন্যাশানল হাই-এ পড়া সাড়ে তিন বছরের কন্যা ভদ্রলোকের প্রতিটি কথায় দিব্য সাড়া দিচ্ছিলো। আমার হঠাৎ মনে হলো ওই সাড়ে তিন বছরের বাচ্ছার ভাবমূর্তি খারাপ করছি না তো আমি! ওকে বোধহয় দোকানি প্রথম প্রজন্মের ইংরিজি ইশকুলে পড়া বলে চিহ্ণিত করেছেন  ও আমাকে মুর্খ ভেবে কিছুতেই আর ভালো জামা দ্যাখাবেন না। কিঞ্চিৎ আমিও জানি প্রমাণ করার লোভে সবে  ইংরিজিতে উত্তর দিতে যাবো মনে পড়ল আমি সদ্য 'বঙ্গপ্রেমিক'-এর সদস্য হয়েছি। আমার বাবা আজন্ম বাংলার অধ্যাপনা করে আমাদের সমস্ত চাহিদা পূরণ করেছেন। মনে পড়ল আমি বাঙালি এতে আমার গর্বিত হওয়া উচিৎ।  ইংরিজির বদলে মুখ থেকে বেরোলো 'পুপে তুমি ভালো করে বাংলা শিখছ তো?' দোকানির মহিলা সঙ্গীটি বুদ্ধিমতী। তাঁর মতো করে বাংলায় বললেন 'দিদি আপনার বিল হয়ে গেছে। কোনও অসুবিধে হলে আসবেন। আমরা আপনাদের জন্য আছি' উচ্চারণ শুনে মনে হল অবাঙালিই হবেন। আমি মনে মনে ভাবলুম তাইতো হওয়া উচিৎ আপনারা আমাদের জন্য থাকলে আমরাও আপনাদের জন্য থাকব। কিন্তু আপনাকে আমাকে দুজনকেই থাকতে হবে যে।

চোখে আঙুল

#চোখে_আঙুল
আজকাল ফেসবুকে অনেকেই লেখেন। মন্দ কী? সকলকে তো প্রকাশক আর পত্রিকারা জায়গা দেন না। তাঁরা যদি লেখেন লিখুন না। যদি পড়বাব যোগ্য না মনে হয় পড়বেন না। কিন্তু এর কিছু একটা শক্তি তো আছে, যা আজ আর অস্বীকারের জায়গা নেই। তাই বহু বিখ্যাত লেখকও আজকাল নিয়ম করে  সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন। এটা জেনেই লেখেন এখানে একটা লেখার আয়ু মাত্র ঘন্টা কয়েক। তাঁদের হাজার হাজার লাইক পড়ে। শেয়ার হয়। ফলে আপনাকে তিনি বন্ধু তালিকায় না রাখলেও আপনি তাঁর লেখা পড়তে পান। আর সে লেখা মনে ধরলে বারবার পড়তে চাইলে, বইয়ের দোকানে গিয়ে খোঁজ করেন।  যাঁরা অখ্যাত তাঁরাও লেখেন। তার মধ্যে কোনও কোনও লেখা মনে ধরে যায়, অসাধারণ হয় ভাইরাল হয়, আবার হারিয়েও যায়। আবার কোনও কোনও লেখা ট্র‍্যাশ হয়, হাস্যকর হয়। আপনার আমার মনে হয় পাতে দেবার যোগ্য নয়। সে লেখাতেই আবার দ্যাখেন কেউ কেউ আহাঃ, উহু করছে। আপনার মন বলে ধুত্তেরি সাব স্টান্ডার্ড লোকজন সব। বেশ করেন ভাবেন। আপনার ভাববার অধিকার আছে। কাছের বন্ধুর সঙ্গে সে নিয়ে আলোচনার অধিকার আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁকে ব্যাথা কেন দেন বলুন তো? তিনি তো আপনার দেওয়ালে গিয়ে লিখছেন না। তাঁর লেখা যদি সমাজ সংসারের অপকার না করে কী ক্ষতি হয় সে যদি বাজেই লেখে।  ফেসবুকের আজকাল একদল গুরু ঠাকুর হয়েছেন। কেবল শুধরে দেওয়ার খেলায় মেতেছেন,বানান, বাক্যের গঠন, কোথায় থামবেন, কোথায় চলবেন, কতটা কবিতা হলো, গল্পের দূর্বলতা কি, লেখার মান ইত্যাদি ইত্যাদি। কী হয় দিদিরা, দাদারা এতে? অন্যকে  কিস্যু হচ্ছে না বললে আপনি অনেক পারেন এইটে প্রমাণ করা যায়। আর কী হয় একটু বলবেন প্লিজ। শুধরে যদি দিতেই হয় তাঁর ইনবক্সে গিয়ে দিন। অথবা নিজের পেজে নিয়মিত একটা রিভিউ সেকশন রাখুন। ভালো সমালোচকের বড় অভাব। তর্ক করুন, ব্যঙ্গ করবেন না। 
আসলে মেয়েদের একটি ফেসবুক পেজ আছে পুকুরঘাট। তাতে একটি মেয়েকে আজ লিখতে বলায় সে বলল ’ওরে বাবা না নীলা দি আর লিখব না। আমি লিখলেই লোকে যে ভাবে  ভুল ধরে, বানান ভুল ধরে আমি আর লিখব না।’ বিশ্বাস করুন মেয়েটা বড় একা আর ।এই টুকুই তাঁর মুক্তির জায়গা ছিল। ও জানে ও কোনও দিনও ভার্জিনিয়া উলফ বা লীলা মজুমদার হবে না। তবুও ইন বক্সে কতদিন কবিতা পাঠিয়েছে, নানান লেখা পাঠিয়েছে আমায়। কখনও পড়েছি কখনও পড়াও হয়নি। যেদিন পড়েছি বলেছে জানো তো দিদি আমার অমুক ঘটনা থেকে লিখেছি। ওই টুকু কত মানুষের কেড়ে নিচ্ছেন এই হতাশ, চোখে আঙুল দাদা দিদিরা ভেবে দেখুন। 
পরিশেষে  খুব সংক্ষেপে একটা গল্প শোনাই। একজন একটা ছবি এঁকে তার বাড়ির বাইরে রেখে ছিলেন কেমন হয়েছে জানতে চেয়ে। তাতে সমালোচকরা নানা রকম ভুল ধরতে শুরু করলেন। লোকটি বলল আপনারা এক কাজ করুন কালো রঙ দিয়ে জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দিন। আমি পরদিন শুধরে নেব। দ্যাখা গেলো গোটা ছবি প্রায় কালো দাগে ভরে গেছে। পরদিন ছবি শুধরে আবার রাখল আবার ছবি কালো দাগে ভরে উঠল। ভদ্রলোক হতাশ হয়ে বন্ধুকে সে কথা বলাতে বন্ধু বলল এক কাজ কর আজ আর কালো কালি না রেখে  রঙ রেখে বল ছবি শুধরে না দিয়ে ছবি এঁকে দিতে। তাতে পরদিন থেকে দ্যাখা গেলো ক্যানভাস ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ আঁচড়ও কাটেনি। কাজেই কাউকে ভয় না পেয়ে নিজেকে মেলে ধরুন।বিশ্বাস করুন যাঁরা প্রকাশ্যে ভুল ধরেন  তাঁরা আসলে আপনার ক্ষমতাকে ভয় পান। তবে যাঁরা পরম মমতায় আপনাকে একান্তে শুধরে দেন তাঁরা কিন্তু আপনার বন্ধু।

খিস্তি ও রাজনীতি

#খিস্তি_ও_রাজনীতি
এমন নয় যে খিস্তির উৎপত্তি অতি সম্প্রতি।  কিন্তু খিস্তির রাজনৈতিক এবং সামাজিক  অনুমোদন বা প্রকাশ্য উচ্চারণ বা লেখার অনুমোদন সম্প্রতিই বটে। আধুনিক, স্মার্ট আর্টের অনেকগুলি অনুষঙ্গের একটি হয়ে উঠছে খিস্তি। রাস্তা-ঘাটে, অফিসে, ইশকুলে, সিনেমায়, থিয়েটারে সর্বত্র লোকে অনায়াসে খিস্তি দিয়ে চলেছে। আমাদের কান ক্রমশ খিস্তিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এর কারণ নিশ্চয়ই পুঞ্জিভূত রাগ এবং সামাজিক অবদমন। যার মধ্যে যৌন অবদমনও আছে। কিন্তু খিস্তি বক্তার সমস্ত না পাওয়াকে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে দেখলেও আমার মন এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা যে আমার সংস্কৃতিতে ক্রমশ খিস্তি বিস্তার করবে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে রাজনৈতিক উষ্মা প্রকাশের একটা বড় অস্ত্র হয়ে উঠছে খিস্তি। অনায়াসে এক পার্টি অপর পার্টিকে খিস্তি করে চলেছে। এ ব্যাপারে কোনও রাজনৈতিক দল এতটকু কম যায় না। কেউ তিয়াত্তর বছরের মহিলা শিল্পীকে যৌনদাসী বলে বাজারে মিম ছাড়ছে, তাদের সমর্থকরা বিরোধীতা দেখলেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রকাশ্যে সোশ্যাল প্লাটফর্মগুলিতে খিস্তি লিখছে। আবার কেউ সেই মিম ছাড়া রাজনৈতিক দলকে অসভ্যতার জবাব দিতে গিয়ে  দিতে গাঁ... মারব, চো...না, চু...য়া, ক্যা...বো ইত্যাদি অনায়াসে বলছেন এ ব্যাপারে বাম, বিজেপি,তৃণমূল, কংগ্রেস কেউ পিছিয়ে নেই। কিন্তু স্বপনেও ভাবা যায় না  জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রণব মুখার্জি , অটল বিহারী বাজপাই ইত্যাদি নেতারা প্রকাশ্যে কাউকে খিস্তি দিচ্ছেন। অথচ তাঁদের পার্টির অনুগামীদের ইদানিং এটাই প্রতিবাদের ধরন হয়ে উঠছে। যে যত বেশি অশ্লীল শব্দে প্রতিবাদ করছে যেন সে ততবেশি পার্টির অনুগত। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে যে অবগত নয় এমনটা তো নয়। কিন্তু দলগুলো এটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, বাড়তে দিচ্ছে এই সংস্কৃতি, ইচ্ছে করলেই তারা এগুলো আটকাতে পারে, কিন্তু করছে না। কেন? যত তুমি উত্তেজিত থাকবে তত তোমার সত্য দেখার ক্ষমতা কমবে। আর যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ  শব্দে উত্তেজনা আরও বেশি। তাই এককালে যা পার্টি গুন্ডা পার্টি মস্তানরা উচ্চারণ করত আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় পার্টি সমর্থকরা অনায়াসে বলছে সেসব শব্দ। মনে রাখবেন আমার আপনার সন্তানের মধ্যেও প্রোথিত হচ্ছে এই সংস্কৃতি। কাজেই সচেতন না হলে আপনিও রেহাই পাবেন না খিস্তি খাওয়া থেকে। তাতে যদি আপনার কিছু এসে যায় না তবে খিস্তি প্রাক্টিস করুন প্রাণ ভরে। নয়ত সন্তানকে আটকান।

মাক্কালী আপনি অনেক ভালো

#মাক্কালী_আপনি_অনেক_ভালো
ধরুন আপনি সারাদিন শাড়ি গয়নার গল্প করেন, রান্নার পোস্ট দেন, শ্বেত ভল্লুকের ফুটবল খেলা আর সুইট বেবি'জ গ্রুপের পোস্ট শেয়ার করেন ।মেয়েকে ইশকুলে দিতে গিয়ে পি এন পি সি না করলে ঘুম আসেনা। আপনি বামও নন বিজেপিও নন, কংগ্রেস তৃণমূলও নন।  বাড়ির লোকেরা যেখানে ভোট দেয় আপনিও সেখানে দেন। আর ভোটের দিন সকালে বরের সঙ্গে ঝগড়া হলে ববের উলটো পাটিতে ভোট দেন, সে ক্ষেত্রে আপনার কী কী হবে? আপনাকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনবে না, বাড়ির লোকেরা অবিডিয়েন্ট ভাববে, ফেসবুকের বুদ্ধিমানরা গেঁয়ো অসংস্কৃত বোকা হাবলা ভাববে, বিপ্লবীরা ভোগী ভাববে। আপনার কাছে অনুরোধ আপনি নিজেকে একদম বদলাবেন না। আপনি নির্ভিক এবং সৎ। যারা স্টার ওয়াক্সে হাজার টাকার কফিও খায়, সাতশো টাকার দেশী শাড়ি, জামা হান্ডলুম স্টিকার লাগিয়ে সাত হাজারেও পরে, সিডানে চেপে সুইমিং পুলে গিয়ে  ওজনও কমায়, দামি ওয়াইন লোকের ঝেড়ে খেলে ফটোও দেয়, কোমরে ঘুনসিও বাঁধে আবার নেরুদা, দেরিদা পড়ে আর ফেসবুকে এসে হেব্বি বিল্পব করে মা কালীর দিব্যি তাদের থেকে আপনি আমি অনেক ভালো।  জয় লেনিন, জয় শ্রীরাম,  মা মাটি মানুষের জয়, জয় নেহেরু একদম কিচ্ছু বলবেন না। ইচ্ছে হলে জয় হাজি পীর, জয়  শ্রী রাধে, যিশু বাবার জয় যা খুশি বলুন নয়ত বলুন জয় বাঙালির জয় অথবা জয় বাবা ফেলুনাথ।

মাক্কালী আপনি অনেক ভালো

#মাক্কালী_আপনি_অনেক_ভালো
ধরুন আপনি সারাদিন শাড়ি গয়নার গল্প করেন, রান্নার পোস্ট দেন, শ্বেত ভল্লুকের ফুটবল খেলা আর সুইট বেবি'জ গ্রুপের পোস্ট শেয়ার করেন ।মেয়েকে ইশকুলে দিতে গিয়ে পি এন পি সি না করলে ঘুম আসেনা। আপনি বামও নন বিজেপিও নন, কংগ্রেস তৃণমূলও নন।  বাড়ির লোকেরা যেখানে ভোট দেয় আপনিও সেখানে দেন। আর ভোটের দিন সকালে বরের সঙ্গে ঝগড়া হলে ববের উলটো পাটিতে ভোট দেন, সে ক্ষেত্রে আপনার কী কী হবে? আপনাকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনবে না, বাড়ির লোকেরা অবিডিয়েন্ট ভাববে, ফেসবুকের বুদ্ধিমানরা গেঁয়ো অসংস্কৃত বোকা হাবলা ভাববে, বিপ্লবীরা ভোগী ভাববে। আপনার কাছে অনুরোধ আপনি নিজেকে একদম বদলাবেন না। আপনি নির্ভিক এবং সৎ। যারা স্টার ওয়াক্সে হাজার টাকার কফিও খায়, সাতশো টাকার দেশী শাড়ি, জামা হান্ডলুম স্টিকার লাগিয়ে সাত হাজারেও পরে, সিডানে চেপে সুইমিং পুলে গিয়ে  ওজনও কমায়, দামি ওয়াইন লোকের ঝেড়ে খেলে ফটোও দেয়, কোমরে ঘুনসিও বাঁধে আবার নেরুদা, দেরিদা পড়ে আর ফেসবুকে এসে হেব্বি বিল্পব করে মা কালীর দিব্যি তাদের থেকে আপনি আমি অনেক ভালো।  জয় লেনিন, জয় শ্রীরাম,  মা মাটি মানুষের জয়, জয় নেহেরু একদম কিচ্ছু বলবেন না। ইচ্ছে হলে জয় হাজি পীর, জয়  শ্রী রাধে, যিশু বাবার জয় যা খুশি বলুন নয়ত বলুন জয় বাঙালির জয় অথবা জয় বাবা ফেলুনাথ।

Monday, 4 November 2019

শুভেচ্ছার ঘটা

আমাদের ছোটবেলায় 'শুভ  বিজয়া'  ছাড়া আর কোনও উৎসবে শুভেচ্ছা বিনিময় হত বলে মনে পড়ে না, কেউকেউ বড়জোর পয়লা বৈশাখের পর 'শুভ নববর্ষ' বলতেন। পরে স্কুলে বন্ধুদের 'হ্যাপি বার্থডে' বলেছি, আর বলেছি 'হ্যাপি নিউইয়ার', তাও বাড়ির বড়রা খুব বলতেন টলতেন না, অনেক পরে অন্ত কৈশোরে টেলিগ্রাফে পণ্ডসের বিজ্ঞাপনে 'হ্যাপি ওমেনসডে' কথাটা লেখা দেখেছিলুম। 
পরে কলেজ জীবনে গিয়ে রুশ বিপ্লব, ব্রেশট, স্তানিস্লাভস্কি, কামু, কাফকা, রিয়েলিজিম, ন্যাচারালিজিম, পোস্টমর্ডান ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দ শেখার পর মনে হল আমি এক বিরাট হনু, সবাই যা করে আমি করি না, তাই   প্রকাশ্যে  এই সব শুভেচ্ছা বিনিময় একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলুম। জম্মে কোনোদিন টাইমলাইনে এসব লিখিনি। গত দু তিন বছর ঈদ, থেকে দুজ্ঞা পুজো, বড়দিন, গনেশ পুজো ভূতচতুদ্দশী ইত্যাদির শুভেচ্ছা বিনিময়ের ঢল নেমেছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোতে, আমিও এ বছর ভাবলুম স্রোতের বিপরীতে থেকে কি লেজ গজালো বাবা, সেই নীলা তো নীলাই থাকলুম। এসব না করে লাভ নেই। তাই এবছর নিউইয়ার, নববর্ষ, বাবা দিবস এবং মা দিবসে টাইম্লাইনে ছবি দিয়েছি, শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি,(কালকেও করেছি)। কিন্তু বস আর হবে না, আজ দেখলাম রথযাত্রা, ঈদ আর  অম্বুবাচীর কম্বাইন্ড শুভেচ্ছা, এরপর ঘেঁটু, টুসু, ভাদু, মহরম, মা দুজ্ঞা, সরস্বতী ঠাকুর, যিশুর  পুনরাগমন, বুদ্ধদেব, নানক, প্রেমের দিন, বিচ্ছেদের দিন, পরিবেশ দিবস, বাঘ, ছাগল, হাতি, নাটক, সিনেমা যাত্রা, কবিতা, উপন্যাস আরো অজস্র দিবস বাকি। আমার লেখার মত অতো শব্দ নেই তাই আজ থেকে  আবার সব শুভেচ্ছা বন্ধ, যারা শুভেচ্ছা দক্ষতার সঙ্গে জানাতে  পারেন তাদের মোটেই মন্দ বলছি না।আপনারা আমায় শুভেচ্ছা জানাতেই পারেন, কেবল উত্তর না পেলে রাগ করবেন না।
আজ ২১ জুলাই ২০১৬, চিড়িয়াখানার সামনে দিয়ে যাবার সময় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ট্যাক্সিখানা।পুলিস একদল মানুষকে লাইন করে চিড়িয়াখানায় ঢোকাচ্ছিল, আর একদল মানুষ অপেক্ষা করছিল রাস্তা টপকে ওপারে আসার। এই লাইনেই চোখে পড়ছিল ফ্লুরোসেন্ট গোলাপি চুড়িদার পরা বছর বারোর একটি প্রাণবন্ত, ফুটফুটে মেয়েকে। গায়ের রঙটা একটু বেশিই ঘন।তাতে গোলাপি চুমকি বসান চুড়িদারের মেয়েটি আলাদা করেই চোখে পড়ছিল। ওর পিঠে একঘর মাত্র বোতাম, তাও সেফটিনপিন দিয়ে আঁটা ।সস্তার চুড়িদারের ওড়নাখানা পর্যাপ্ত নয়, ঢলঢলে জামাখানা নিচের দিকে নেমে দ্যাখা যাচ্ছে বুকের অনেকখানি, বুক বলতে আছেই বা কি, ওই কখানা হাড় বইতো নয়, তবুও ও ওড়নাখানা টেনে নিচ্ছিল মাঝেমাঝেই,  জন্ম ইস্তক শিখেছেতো মেয়ে, ঢেকে রাখতে হয়।মেয়েটির হাতে জামার সঙ্গে মেলান বুড়ির চুল ( আদুরে বাচ্ছারা যাকে ক্যান্ডি বলে), পা দুখানা অত ভিড়ের মধ্যে দেখতে পাইনি, হয়তো 'তাঁর' মতই হাওয়াই পরা!ওর ঠোঁটে ছিল চকচকে লাল লিপস্টিক, আর দু চোখে ঘন কাজলের রেখা।সেই চোখ দিয়ে শুষে নিচ্ছিল চারপাশের কলকাতাকে, আহা ভাগ্যি এলি মেয়ে মিটিং করতে।মেয়েটির সঙ্গে ছিল তালঢ্যাঙা এক যুবক।কি যেন বুঝিয়ে চলেছে মেয়েটিকে। হয়ত বলছে আর একটু বাদেই তুই দেখতে পাবি বাঘের খাঁচা কিম্বা হায়নার গর্ত।আচম্বিতে সিগন্যাল খুলে যাওয়াতে ভিড়ের চাপ বাড়ছিল মেয়েটির লাইনখানায়, ঠিক তখনই পেছন থেকে দুটো কালো হাত ঢুকে গেলো মেয়েটির চুড়িদারের গলা দিয়ে। কাজল পরা। বিস্ময়ভরা ওর চোখদুটো কুঁচকে উঠছিল যন্ত্রণায়, আর সেই তালঢ্যাঙা গার্জেনটি পেছন ফিরে একটু হাসি দিলো মাত্র, মনে হল বলে উঠল দেখলি হায়নার গর্ত। আরো দেখাব চল।আমার ট্যাক্সিটা সিগন্যাল পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, অনুরোধ করলাম একটু দাঁড়ান ওদের আটকাই। ড্রাইভার বললেন এখন দাঁড়ালে কেস দেবে। জানেন না আজ ২১ জুলাই। মেয়েটি কি জানত আজ ২১ জুলাই! তাই কি ও বুক পেতে দিলো শহিদের মতো।
আর আমি শহিদ দিবসে ট্যাক্সি চড়ে বেড়ান বাঙালি, কলকাতা দেখে এসে ফেসবুকে লিখি What's in my mind...
আমার পুজোর সেকাল
।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।

আমার কলকাতার পাড়ায় এই দ্বিতীয়ার দিনই পুজো উদ্বোধনে  দেব, আলো জ্বলছে, হোর্ডিং তো পড়ে গেছে সেই কবেই, মাইকিং হচ্ছে, বস্ত্র দানের লাইন, দেবকে দেখার ভিড়, এসবের মধ্যে আমার মনে পড়ছিল দ্বিতীয়া,তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমীর সিঙ্গুরকে। পঞ্চমী অব্দি আমাদের ছিল পুজো আসছে আসছে ভাব, আর ষষ্টির দিন মনে হত এই তো সবে পুজো এলো।
তখন সিঙ্গুরকে কেই বা তেমন চিনত! টাটা হবার পর যে সিঙ্গুরকে মানুষ চিনল সেখানে  টোকা মাথায় কিছু মানুষ, যাদের একদল কারখানা চায় আর একদল জমি চায়, অনাহার, অশিক্ষা, তাপসী মালিক। সত্যি কি তেমন ছিল আমাদের সিঙ্গুর! যারা শীর্ষেন্দুর গল্পে গঞ্জগুলোর বর্ণনা পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন কেমন ছিল আমার দেশ। হপ্তায় দু দিন হাট বসত, গোটা তারকেশ্বর লাইনের ট্রেড সেন্টার ছিল এই সিঙ্গুর, পুজোর আগে ভেতরের গাঁ থেকে হাটে কুলো ধামার সঙ্গে শাড়ি জামা কিনে হেঁটে, সাইকেলে, ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরত লোকে, আর সিঙ্গুরের পয়সাওলা বাবু বাড়ির লোকেরা জামা কিনত বাজারের পাকা দোকান থেকে। তখনো রূপশ্রীর মতো  দু-এক খানা দোকান ছাড়া গদিতে বসিয়ে গস্ত করাই  ছিল দস্তুর। দালান কোঠাওলা মস্ত মস্ত বাড়িতে সাবেকি পুজো হত,( এককালে আমাদের নিজেদের জলাঘাটার বাড়িতেই তাই হত, যা আজ ঠেকেছে ঘটপুজোয়।)। পাশাপাশি বাস করা বামুন মাহিষ্য নির্দ্বিধায় অংশ নিতেন সে পুজোয়, শ্রেণি বিভাজন ছিল না তেমন নয় তবে সে সম্পর্কে তেমন বিদ্বেষ আর সচেতনতা কোনটাই ছিল না। আরো আগের কথা জানি না, আমার ছেলেবেলায় চাষি পরিবারগুলিতে লক্ষ্মী, সরস্বতী বাঁধা পড়ছিল দুরন্ত গতিতে। তাই বামুন, মাহিষ্যের ভেদাভেদ তলানি ঠেকত পুজোর দিনগুলোতে। আর তখনো বামুন, ক্ষত্রিয় এমনকি কিছু মাহিষ্য (সিঙ্গুরে বড় সংখ্যক ক্ষত্রিয় আর ছেত্রী পরিবার আছে) বাড়িগুলোতে ধানের গোলা যেমন ছিল,তেমনি বিলেত আমেরিকা ঘোরা, ডাক্তার, অফিসার, প্রফেসার, ইঞ্জিনিয়র বাবুদের সংখাও ছিল বেশ। ছিল একশ দেড়শ বছরের পুরনো  গার্লস, বয়েজ ইস্কুল, সিঙ্গুর ঘিরে তিন তিনটে রেলওয়ে স্টেশন।এমনকি আমার ছেলেবেলাতে সিঙ্গুরের বুক চিরে দুর্গাপুর রোডও দেখেছি, এসব যেমন ছিল তেমন ছিল পোটো পাড়ার শঙ্কর পোটোর দিঘল চোখের মেঠো দুগগা আর রাধা গোবিন্দ সাহার শিক্ষিত হাতের আর্টিস্টিক প্রতিমা। কেবল ছিল না সিঙ্গুরকে হাস্যকর করার জন্য, করুণার যোগ্য করে তোলার জন্য মিডিয়ার ওবি ভ্যানগুলো, ছিল না বাংলা স্টেটসম্যান, গণশক্তি আর আনন্দবাজারের রিপোর্টিং।
যাক সে সব অন্যকথা, অন্য প্রসঙ্গ। এই দ্বিতীয়ায় আমার অন্তকৈশরের, আমার প্রারম্ভ যৌবনের সিঙ্গুরকে মনে পড়ছিল খুব। (যদিও তখন খুব কাছেই ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছিল টাটা আর তাকে ঘিরে আন্দোলন)।দ্বিতীয়ার দিন কলেজ থেকে সিঙ্গুর স্টেশনে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরতুম, তখন পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা ছিল বটে তবে তেমন জোরাল স্ট্রিট লাইট ছিল না, ফলে ইস্কুল মোড়ের দোকান গুলো পেরোলেই গোটা রাস্তা জুড়ে থাকত আলো অন্ধকার। তার মধ্যে দেখতুম শতাব্দী প্রাচীন সিঙ্গুর ক্লাবে ইলেক্ট্রিক হ্যালোজেন জ্বালিয়ে ত্রিপল পড়ছে বাঁশে। ফটক পেরিয়ে সাতমন্দির তলায় এলেই চোখে পড়ত ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সাতটি শিবের মন্দির। সাতমন্দিরের  কাছে এলেই নাকে ঝাঁপিয়ে পড়ত হাসনুহানার গন্ধ, ও গন্ধটা সারা বছর জড়িয়ে থাকত মন্দির তলায়। তারপর রায় চোধুরী আর বর্মনদের বাড়ি ডান হাতে রেখে এগুলেই পড়ত রাজহাঁসওলা মাটির বাড়িখানা, সেখান থেকে শুরু করে কোথা কোথা দিয়ে যে শিউলির গন্ধ নাকে আসত জানি না। এরপর বাঁ হাতের দুটো গলি পেরুলেই আমার বাড়ির গলি, এই এত্তখানি রাস্তায় একখানাও পুজো চোখে পড়ত না। কেবল রাস্তায় পাড়ার কাকু দাদাদের সঙ্গে দ্যাখা হলে বলত দ্যাখ গিয়ে বাঁশ বাঁধা কমপ্লিট আজ রাত থেকে ত্রিপল পড়বে,কাল থেকে কাপড় বাঁধা। গলির মুখে ওই বাঁশের স্ট্রাকচারটুকু দ্যাখার জন্য হাঁটাত গতি বাড়িয়ে দিতুম কয়েশগুন। তখন আমাদের নবাসনের পুজোছিল রীতিমত জাঁকের পুজো, ওদিকে বিদ্যুতপল্লি, এদিকে অপূর্বপুর আর জলাঘাটার পুজোর মাঝখানের সমস্ত লোকের ছিল  দ্বিতীয়ার দিন বাঁশ বাঁধা আমাদের নবাসনের পুজো। সে এলাকা নেহাৎ কম বড় নয়। আমরা ছিলুম ও প্যান্ডেলের গায়ের গলির লোক তাই মনে একটু গর্ব গর্ব ছিল, ছিল কিঞ্চিৎ দিদিগিরিও। দ্বিতীয়ার বাঁশ বাঁধা থেকে ষষ্টির দিনের সম্পূর্ণ প্যান্ডেল দ্যাখায় ছিল শাজাহানের তাজমহল তৈরি দেখার আনন্দ, সে উত্তেজনার কথা আমার চেয়ে বড় বা আমার সমসাময়িক অনেকেরই মনে আছে নিশ্চই।

কতবছর চাকরী, নানা ঝড় ঝাপ্টা, বাবার চলে যাওয়া, বাড়িতে থেকেও পুজো না দেখার আলিস্যি,পুজোর ভিড়ে বাংলার বাইরে থাকার উন্নাসিকতা, কলকাতার সংসার, এসব মিলিয়ে সিঙ্গুরের পুজো দ্যাখা হয়নি। চতুর্থীর দিন পড়ি কি মরি করে ছুটলাম সিঙ্গুরের পুজো দেখতে। কিন্তু একি চতুুর্থীর সিঙ্গুরের রূপ! না দেবের উদ্বোধন হয়ত হয়নি, কিন্তু রাস্তা জুড়ে ঝলমলে আলো, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, প্রসাধনীর দোকানে লাইন, ত্রি কোয়াটার জিন্স আর টপ গায়ে ট্রুলি গ্লোবাল ছেলে মেয়ে, মোমোর দোকান,ফ্লাটবাড়ি থেকে ঝুলতে থাকা আলো, অনলাইন শপিং-এর স্কুটার। এই আমার সিঙ্গুরের চতুর্থী! আমি সিঙ্গুরে আসিনা তা তো না, আমার তো আন্দাজ করা উচিৎ ছিল বদলে যাওয়া চতুর্থীর...
ক্রমশ...

আমার পুজোর সেকাল


আমার কলকাতার পাড়ায় এই দ্বিতীয়ার দিনই পুজো উদ্বোধনে  দেব, আলো জ্বলছে, হোর্ডিং তো পড়ে গেছে সেই কবেই, মাইকিং হচ্ছে, বস্ত্র দানের লাইন, দেবকে দেখার ভিড়, এসবের মধ্যে আমার মনে পড়ছিল দ্বিতীয়া,তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমীর সিঙ্গুরকে। পঞ্চমী অব্দি আমাদের ছিল পুজো আসছে আসছে ভাব, আর ষষ্টির দিন মনে হত এই তো সবে পুজো এলো।
তখন সিঙ্গুরকে কেই বা তেমন চিনত! টাটা হবার পর যে সিঙ্গুরকে মানুষ চিনল সেখানে  টোকা মাথায় কিছু মানুষ, যাদের একদল কারখানা চায় আর একদল জমি চায়, অনাহার, অশিক্ষা, তাপসী মালিক। সত্যি কি তেমন ছিল আমাদের সিঙ্গুর! যারা শীর্ষেন্দুর গল্পে গঞ্জগুলোর বর্ণনা পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন কেমন ছিল আমার দেশ। হপ্তায় দু দিন হাট বসত, গোটা তারকেশ্বর লাইনের ট্রেড সেন্টার ছিল এই সিঙ্গুর, পুজোর আগে ভেতরের গাঁ থেকে হাটে কুলো ধামার সঙ্গে শাড়ি জামা কিনে হেঁটে, সাইকেলে, ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরত লোকে, আর সিঙ্গুরের পয়সাওলা বাবু বাড়ির লোকেরা জামা কিনত বাজারের পাকা দোকান থেকে। তখনো রূপশ্রীর মতো  দু-এক খানা দোকান ছাড়া গদিতে বসিয়ে গস্ত করাই  ছিল দস্তুর। দালান কোঠাওলা মস্ত মস্ত বাড়িতে সাবেকি পুজো হত,( এককালে আমাদের নিজেদের জলাঘাটার বাড়িতেই তাই হত, যা আজ ঠেকেছে ঘটপুজোয়।)। পাশাপাশি বাস করা বামুন মাহিষ্য নির্দ্বিধায় অংশ নিতেন সে পুজোয়, শ্রেণি বিভাজন ছিল না তেমন নয় তবে সে সম্পর্কে তেমন বিদ্বেষ আর সচেতনতা কোনটাই ছিল না। আরো আগের কথা জানি না, আমার ছেলেবেলায় চাষি পরিবারগুলিতে লক্ষ্মী, সরস্বতী বাঁধা পড়ছিল দুরন্ত গতিতে। তাই বামুন, মাহিষ্যের ভেদাভেদ তলানি ঠেকত পুজোর দিনগুলোতে। আর তখনো বামুন, ক্ষত্রিয় এমনকি কিছু মাহিষ্য (সিঙ্গুরে বড় সংখ্যক ক্ষত্রিয় আর ছেত্রী পরিবার আছে) বাড়িগুলোতে ধানের গোলা যেমন ছিল,তেমনি বিলেত আমেরিকা ঘোরা, ডাক্তার, অফিসার, প্রফেসার, ইঞ্জিনিয়র বাবুদের সংখাও ছিল বেশ। ছিল একশ দেড়শ বছরের পুরনো  গার্লস, বয়েজ ইস্কুল, সিঙ্গুর ঘিরে তিন তিনটে রেলওয়ে স্টেশন।এমনকি আমার ছেলেবেলাতে সিঙ্গুরের বুক চিরে দুর্গাপুর রোডও দেখেছি, এসব যেমন ছিল তেমন ছিল পোটো পাড়ার শঙ্কর পোটোর দিঘল চোখের মেঠো দুগগা আর রাধা গোবিন্দ সাহার শিক্ষিত হাতের আর্টিস্টিক প্রতিমা। কেবল ছিল না সিঙ্গুরকে হাস্যকর করার জন্য, করুণার যোগ্য করে তোলার জন্য মিডিয়ার ওবি ভ্যানগুলো, ছিল না বাংলা স্টেটসম্যান, গণশক্তি আর আনন্দবাজারের রিপোর্টিং।
যাক সে সব অন্যকথা, অন্য প্রসঙ্গ। এই দ্বিতীয়ায় আমার অন্তকৈশরের, আমার প্রারম্ভ যৌবনের সিঙ্গুরকে মনে পড়ছিল খুব। (যদিও তখন খুব কাছেই ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছিল টাটা আর তাকে ঘিরে আন্দোলন)।দ্বিতীয়ার দিন কলেজ থেকে সিঙ্গুর স্টেশনে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরতুম, তখন পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা ছিল বটে তবে তেমন জোরাল স্ট্রিট লাইট ছিল না, ফলে ইস্কুল মোড়ের দোকান গুলো পেরোলেই গোটা রাস্তা জুড়ে থাকত আলো অন্ধকার। তার মধ্যে দেখতুম শতাব্দী প্রাচীন সিঙ্গুর ক্লাবে ইলেক্ট্রিক হ্যালোজেন জ্বালিয়ে ত্রিপল পড়ছে বাঁশে। ফটক পেরিয়ে সাতমন্দির তলায় এলেই চোখে পড়ত ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সাতটি শিবের মন্দির। সাতমন্দিরের  কাছে এলেই নাকে ঝাঁপিয়ে পড়ত হাসনুহানার গন্ধ, ও গন্ধটা সারা বছর জড়িয়ে থাকত মন্দির তলায়। তারপর রায় চোধুরী আর বর্মনদের বাড়ি ডান হাতে রেখে এগুলেই পড়ত রাজহাঁসওলা মাটির বাড়িখানা, সেখান থেকে শুরু করে কোথা কোথা দিয়ে যে শিউলির গন্ধ নাকে আসত জানি না। এরপর বাঁ হাতের দুটো গলি পেরুলেই আমার বাড়ির গলি, এই এত্তখানি রাস্তায় একখানাও পুজো চোখে পড়ত না। কেবল রাস্তায় পাড়ার কাকু দাদাদের সঙ্গে দ্যাখা হলে বলত দ্যাখ গিয়ে বাঁশ বাঁধা কমপ্লিট আজ রাত থেকে ত্রিপল পড়বে,কাল থেকে কাপড় বাঁধা। গলির মুখে ওই বাঁশের স্ট্রাকচারটুকু দ্যাখার জন্য হাঁটাত গতি বাড়িয়ে দিতুম কয়েশগুন। তখন আমাদের নবাসনের পুজোছিল রীতিমত জাঁকের পুজো, ওদিকে বিদ্যুতপল্লি, এদিকে অপূর্বপুর আর জলাঘাটার পুজোর মাঝখানের সমস্ত লোকের ছিল  দ্বিতীয়ার দিন বাঁশ বাঁধা আমাদের নবাসনের পুজো। সে এলাকা নেহাৎ কম বড় নয়। আমরা ছিলুম ও প্যান্ডেলের গায়ের গলির লোক তাই মনে একটু গর্ব গর্ব ছিল, ছিল কিঞ্চিৎ দিদিগিরিও। দ্বিতীয়ার বাঁশ বাঁধা থেকে ষষ্টির দিনের সম্পূর্ণ প্যান্ডেল দ্যাখায় ছিল শাজাহানের তাজমহল তৈরি দেখার আনন্দ, সে উত্তেজনার কথা আমার চেয়ে বড় বা আমার সমসাময়িক অনেকেরই মনে আছে নিশ্চই।

কতবছর চাকরী, নানা ঝড় ঝাপ্টা, বাবার চলে যাওয়া, বাড়িতে থেকেও পুজো না দেখার আলিস্যি,পুজোর ভিড়ে বাংলার বাইরে থাকার উন্নাসিকতা, কলকাতার সংসার, এসব মিলিয়ে সিঙ্গুরের পুজো দ্যাখা হয়নি। চতুর্থীর দিন পড়ি কি মরি করে ছুটলাম সিঙ্গুরের পুজো দেখতে। কিন্তু একি চতুুর্থীর সিঙ্গুরের রূপ! না দেবের উদ্বোধন হয়ত হয়নি, কিন্তু রাস্তা জুড়ে ঝলমলে আলো, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, প্রসাধনীর দোকানে লাইন, ত্রি কোয়াটার জিন্স আর টপ গায়ে ট্রুলি গ্লোবাল ছেলে মেয়ে, মোমোর দোকান,ফ্লাটবাড়ি থেকে ঝুলতে থাকা আলো, অনলাইন শপিং-এর স্কুটার। এই আমার সিঙ্গুরের চতুর্থী! আমি সিঙ্গুরে আসিনা তা তো না, আমার তো আন্দাজ করা উচিৎ ছিল বদলে যাওয়া চতুর্থীর...
ক্রমশ...

আপনারা অনড়

আপনারা অনড়। আসলে নবান্ন থেকে এন. আর. এস অথবা এন. আর.  এস থেকে নবান্ন অব্দি কোনও রাস্তা নেই কেবল আছে অসীম শূন্য। আর মাঝখানে অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছেন ওদেরকে। হ্যাঁ ওরা। আমরা নই। আমরা যারা  সোশ্যাল মিডিয়ায় গর্জে উঠছি, যারা বুদ্ধিজীবী,  যারা সেলিব্রিটি,  যারা নেতা এমনকি যারা আন্দোলনরত জুনিয়ার ডাক্তার তাঁরা বা তাঁদের স্বজনেরা,তাঁদের  অধিকাংশকেই যেতে হয় না সরকারি হাসপাতালে। ওদের হয়।
ওদের যখন কেস ক্রিটিকাল হয় তখন ওদের গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে রেফার করা হয় সদর হাসপাতালে, সদর হাসপাতাল থেকে কলকাতার সরকারি হাসপাতালে। ওরা গামছায় দুটি মুড়ি বেঁধে মুমূর্ষু মানুষটিকে পাঁজাকোলে করে ছোটে এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে। লম্বা টিকিটের লাইন দেয়, গাছতলায় রোগীকে শুইয়ে রেখে মাথায় হাতপাখার হাওয়া দেয়, কখন ডাক আসে সেই ভয়ে হাসপাতালের বাইরে গিয়ে খাওয়া হয় না ওদের। কোকাকোলার ছিপি লাগান স্প্রাইটের বোতলে জল ভরে খায় কেবল খিদে মেটাতে। হাসপাতালে কর্মচারীদের কখন নম্বর আসবে জানতে চাইলে মুখ ঝামটা খায়, কেউ কেউ উত্তর দেবার প্রয়োজনই মনে করেন না। আবার কেউ কেউ বলে অতো তাড়া থাকলে প্রাইভেট হস্পিটালে যাও। ওরা মরিয়া হয়ে সেখানে ছোটে। যে বেলভিউয়ে, আপোলোতে  আপনাদের চিকিৎসা হয় সেখানকার দরোয়ান ওদের ঢুকতেও দেয় না।
ওঁরা অবাক দৃষ্টিতে দেখে আপনারা, আমরাও কেমন ঠান্ডা মেশিন লাগান হসপিটালে ঢুকে, রোগীর জন্য একরাশ চিন্তা  নিয়ে, মাথায় সানগ্লাস তুলে হসপিটাল অনুমোদিত সিসিডিতে বসে তিনশ টাকার কফি খাই।
তারপর দেখে টিকিটের নম্বর আসার আগেই গাছতলায় শুয়ে থাকা সেই স্বজন শেষ বারের মত হায় আল্লা বলছেন নয়ত হাঁ করে আছে মুখে শেষ ঢোঁক গঙ্গাজলের জন্য।
এরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়, মনে হয় এতো অসাম্য, আমিও তো মানুষ। রাগে, দুঃখে হতাশায় ওঁরা গণপ্রহার করে। আর কাদের মারে? সেই গুটিকয় ডাক্তার নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী যাঁরা নিজেদের ক্ষমতার চেয়ে বহু,বহু গুণবেশি রোগীকে পরিসেবা দেয়। যাঁদের হাত, পা বাঁধা আপনার আমার কাছে।
যারা মারেন তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য,  কর্মসংস্থান দেন না, আমরাও ভাবি না।  দেন কেবল একরাশ আশ্বাস, আর যারা মার খায় তাঁদের পরিকাঠামো দেন না, দেন অপরিসীম কাজের চাপ। মাঝখান থেকে তৈরি হয় একরাশ ভিক্টিম আর ক্রিমিনাল।
🙏🙏🙏 দুজনরাই খানিকটা করে যান না। ওই শূন্যে একখানা পথ গড়ে তুলুন না। নাই বা বাড়ালেন আর ভিক্টিম আর ক্রিমিনালের সংখ্যা।

নাটক লেখকরা ভাবুন



নাটক পাঠযোগ্য সাহিত্য তো বটেই।কিন্তু গল্প উপন্যাসের সঙ্গে তার মূল তফাত হল অধিকাংশ নাটক লিখিতই হয় নির্মিত হবার জন্য বা প্রযোজিত হবার জন্য। একথা অস্বীকারের উপায় নেই নিজের লিখিত নাটক মঞ্চের ওপর অভিনীত হতে দেখলে যে তৃপ্তি অনুভূত হয় তা প্রায় সমস্ত যুগের সমস্ত নাটককারের ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু যদি নাটকলিখিয়ে তাঁর নাটকের অদ্ভুত, বিকৃত বা প্রায় কোনও ব্যাকরণ না মেনে পরিবর্তত রূপ দ্যাখে,  তার কষ্ট এবং হতাশাও সর্বকালের সমস্ত লিখিয়েদের ক্ষেত্রে একই রকম সত্যি।
আমি নিজে নাটক লেখার ক্ষেত্রে দেখেছি অনেক নাট্যদলই সম্পাদনার নামে মূল নাটকটির যা হাল করেন তা নাটককারের পক্ষে কেবল যন্ত্রনার নয় রীতিমত অপমানের। নাটকলিখিয়েরা কিন্তু কোনোরকম চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও বিনা দ্বিধায়  তা মেনে নেন। আমি নিজেও একাধিকবার তা করেছি। মানছি প্রযোজনার প্রয়োজনে লিখিত নাটক ক্ষেত্রবিশেষে বদলাতে হতে পারে, কিন্তু তা নাটককার বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তাঁর অনুমতি ছাড়া বা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কী করে সম্ভব হয়! অথবা তাঁর অবর্তমানে উত্তরাধিকারের অনুমতিও অন্তত নেওয়ার প্রয়োজন বলেই মনে হয়। এমন কি কপিরাইট চলে যাওয়া নাটকের বেলাতেও সে নাটক নিয়ে যা খুশি করা যায় নাকি ভেবে দেখাবার কথা। আমার ধারণা গল্প উপন্যাসের নাট্যরূপের ক্ষেত্রেও এমনটাই  সত্যি। এতে নাটককার বা লেখকদের নিজেদের প্রতিবাদ তো নেই বটেই, তাঁদের স্বজন বন্ধুদেরও অধিকাংশ সময় নির্মাতার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। বাঙালি লেখকদের দূর্ভাগ্য যে তাঁদের নিজেদের কোনো সংগঠন নেই, সংগঠন তো দূরের কথা কোনোরকম ঐক্যমত্যই নেই।  আইন তো নেই বলাই বাহুল্য।ফলে অমুক অবলম্বনে নির্মিত বা সম্পাদিত বলে যা দেখি তা হতবাক করে দেয়, অপমানিত করে। এমনও দেখেছি অমুকের নাটক অবলম্বনে অমুকের নাটক লিখতে লিখতে  মূল নাটককারের নামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।  ছেপে বেরোন নাটক একেবারে অনুমোদন ছাড়া পাড়ার দল অভিনয় করছে এ অভিজ্ঞতা নেই এমন কথা হলপ করে কজন নাটককার বলতে পারবেন আমার সন্দেহ আছে।  এই সমস্তই  কোনোরকম ব্যবস্থাগ্রহণ না করেই মেনে নেন নাটক লেখকরা। 
অথচ ভেবে দেখুন নাটক কিন্তু বেশিরভাগ সময় থেকে গেছে নাটককারের নামে। ইস্কাইলাস, সোফোক্লেস, ইউরিপিদিস,শেক্সপিয়রের  ইবসেনের নাটক, রবীন্দ্রনাথ, তুলসী লাহিড়ি, বিজন ভট্টাচার্য, বাদল সকারের নাটক। জীবিত প্রখ্যাত নাটককারদের নাম না করেই বলা চলে ভবিষ্যতে নাটক যদি বেঁচে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের নামেই বেঁচে থাকবে। অথবা আরও যাঁরা এখন  নাটক লিখে চলেছেন তাঁদের বহুজনের ক্ষেত্রেও এটাই সত্যি হবে এইটকু স্থির বিশ্বাস। 
 অতয়েব যাঁরা আমরা নাটক লিখি  তাদের কিসের এতো আত্মবিশ্বাসের অভাব তা ভেবে দেখবার সময় এসেছে। ভুললে চলবে না লেখকরা কিন্তু গোটা নির্মাণটির ভ্রূণ। এখনও পর্যন্ত আমাদের নির্মানের ধরণে লেখকের অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। এ সময়ের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম,  আমাদের গর্ব আমাদের সম্পদ ক্লাসিক প্লে অথবা ধ্রুপদী নাটকগুলি যেন বিকৃত না হয় সেটুকু দেখার মত শিরদাঁড়ার জোর আমরা অন্তত রাখতে পারি, তাইনা?

ইফতার



দিন চারেক আগে সোমা দি, ফারহাদ দার দোকানে গেছিলাম  নিউমার্কেটে। কিছু কাজ ছিল ওখানে। সঙ্গে টুকটাক গল্পগাছাও হচ্ছিল। ঈদের খদ্দেরদের বেশ ভিড়। ওরাও বিকেল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠছিল। 'আজ চলি' বলে পাঁচটা নাগাদ উঠে পড়লাম। সোমা দি বলল 'আর ঘন্টাখানেক থেকে যা একদম আমাদের সঙ্গে ইফতার করে যাবি। '  'পরে একদিন হবেখন' বলে এগিয়ে গেলাম দোকান থেকে।

 বেরিয়ে দেখলাম বেশ ভিড়। যাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন অধিকাংশই মুসলমান। বুঝলাম ঈদের কেনাকাটার ভিড়। হগ মার্কেটের সামনে ব্যাগের দোকানগুলোর নিচে বসে  কয়েকজন মাথায় ফেজ টুপি পরে  বিরাট থালায় ফল কোঁচাচ্ছেন। কলা, খেজুর,  তরমুজ,ছোলা আরো যেন কিসব রাখা। এক ভদ্রমহিলা  ফোনে কাকে যেন জোরে জোরে বলছেন 'এখন গলা শুকায়ে কাঠ, ইফতার হলে ফোন করব' তার পাশের মেয়েটি বোরখার ওপর দিয়ে একটা সোনালী হার গলায় দিয়ে দেখছে মানায় কিনা, আর ইমিটেশনের দোকানদার আয়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে।  মেয়েটির পায়ের কাছেই কাঠের গাড়ি চেপে একটি মুসলমান দরিদ্র  হাত পেতে বসে আছেন, সে জানে হার কেনার পর মেয়েটি দশটি টাকা হলেও দেবে ওঁর হাতে। বড় রঙিন লাগছিল সমস্ত ছবি। আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে লিন্সে স্ট্রিটের দিকে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ ওই ভিড়ে একটা বাইক কালো ধোঁয়া উড়িয়ে আমায় প্রায় ধাক্কা মেরে চলে গেলো। বাইকে বসা ছেলে দুটির একজনেরও মাথায় কোনো হেলমেট নেই।  বাইকটারর থেকে বেরোন কালো ধোঁয়া আমার নাক মুখ দিয়ে খানিক ঢুকে গেলো। একে এতো ভিড়, তার মাঝখানে ওই বেপরোয়া বাইক চমকে দেওয়ায় আমার কষ্ট হচ্ছিল নিশ্বাস নিতে। পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন 'ওদের কিছু বলতে পারবেন না, তা হলেই দাঙ্গা। ওরা কোনো নিয়ম না মানলেও সরকার চুপ, এই রাস্তায় কি গাড়ি চলে! কিন্তু ওরা চালাবে। তারপর দেখুন মাথায় ওদের নিজেদের টুপি আছে ব্যস হেলমেটের দরকার নেই' ভদ্রলোক আমার মাথায় সিঁদুরের রেখা দেখে বুঝেই গেছিলেন আমি 'ওরা' নই। কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যাই আমি। কিন্তু বাইকের ওই কালো ধোঁয়া আর অপরিচিত ভদ্রলোকের শব্দগুলি কেমন কুন্ডুলি পাকিয়ে আমার বুকে চেপে বসছিল ক্রমশ। আমার রীতিমত শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল।

হঠাৎ আমার স্কুলের সহপাঠী দুই ভাই বোনের কথা মনে পড়ল। ফারজানা আর মুস্তাক। ওদের নিয়ে একবার বন্দনা  বলে একটি মেয়ের বাড়ি গেছিলাম সরস্বতী পুজোর দিন। বন্দনার মা আমাদের থালায় সাজিয়ে ভোগের খিচুড়ি দিয়েছিলেন। ওরা তা খেতে অস্বীকার করে, বলে ’আমরা প্রসাদ খাই না, প্রসাদ খেলে পাপ লাগে' কাকিমা তারপরেও নানা রকম খাবার প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, বলছিলেন 'অমুকটা খাও, ওটা প্রসাদ না' ওরা সমানে খেতে অস্মমত হয়। 'পূজা বাড়িতে আমরা খাই না' এই বলে।  মনে পড়ছিল বন্দনার মায়ের অপ্রস্তুত শুকনো মুখখানার কথা। মনে পড়ল সহকর্মী আজহারের কথা, কোনো দিনও আমাদের দেওয়া একটুকরো খাবারো খায়নি যদি প্রসাদ হয়, অথচ ওর আনা কাবাব অনেকেই গান্ডে পিন্ডে গিলেছে। ভেতরে ভেতরে হিলহিল করে বলে উঠি আমরাই যত আদিখ্যেতা করি। ওরা তো লিবারেল হয় না। ভালো হয়েছে ইফতার করিনি।

 মার্কেটের ভেতরে ঢুকে দেখি অধিকাংশই মুসলমান দোকানদার, দোকানের সামনে অনেকেই ইফতারের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কানে ভেসে আসে ' ওয়ে নুরুল শুন নারায়ন কি আম্মা নে বেগুনী ভেজা ও রাখনা মেরে লিয়ে, সব খুদ মাত খা লেনা' আমি ঘুরে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মনে হল সামান্য কালো ধোঁয়া বুক থেকে বেরোল বুঝি। গুটিগুটি পায়ে একটা জামাকাপড়ের দোকানের দিকে এগোই, দেখি একটি মুসলমান পরিবার কেনাকাটায় ব্যস্ত। এক ভদ্রলোক বছর পঁতাল্লিশ, বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা আর তিনটি বাচ্ছা। তার মধ্যে বড় মেয়েটি বছর চোদ্দ হবে ওড়না দিয়ে মাথা মোড়া।কালোর ওপর মুখখানা ভারি মিষ্টি। পরিবারটিকে দেখে খুব অস্থাপন্ন নয় বলেই আন্দাজ হচ্ছিল। বড় মেয়েটি বাবার কাছে বায়না করে ’ বাবা দুটা সালোয়ার কামিজই দাও' মা বকা দেয়। ’ এতো বড় মেয়ে বায়না করলে ভাইরা  কি করে' মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ’ এই একটা জামা!  দুর্গা পুজোর  সময় কি পরে বের হব তবে, গত বছরও পুরান জামা পরে ঠাকুর দেখতে গেছি' মা বলে ' পুজোর সময় আবার কিনে দিবে আব্বা। দেয় তো তোদের, এখন থিকে কিনে কি হবে'। ওরা হাঁটতে হাঁটতে অন্য দোকানের দিকে এগোয়। আমার বুক থেকে একরাশ কালো ধোঁয়া উড়ে যায়।

যখন মার্কেটের থেকে বেরিয়ে হাঁটছি সকলে ইফতার সারছে। এক থালা থেকে বসে গোল হয়ে খাচ্ছে সকলে। লাইট হাউসের  সামনে দেখলাম প্লাস্টিকের গ্লাসে লাল লাল সরবৎ বিলি করছে ইফতারের জন্য। ওখানটা খুব ভিড়। সারাদিন শুকিয়ে থাকা মানুষ চোঁ চোঁ করে খাচ্ছে সেই জল, নাকি পানি বলব! আজকাল তারকেশ্বরের জলযাত্রীদের জন্যও এই ব্যবস্থা দেখি। হাইজিন টাইজিন ইত্যাদি ভেবে কোনো দিনও খাইনি। বড় বুকটা শুকিয়ে ছিল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম ’ আমায় একটু পানি দিন’ কে যেন বলল 'দিদিকে জল দে। ' আমার হাতে ওই প্লাস্টিকের গ্লাস দিতেই  এক মহিলা হাতের ওপর দু চারটে ভিজে ছোলা দিল। চেয়ে দেখলাম আপাদমস্তক মোড়া বোরখায়। তবুও যেন একটা মৃদু হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম। 

ছোলা চিবোতে চিবোতে এগোচ্ছিলাম, সোমা দি ফারহাদ দার দোকানে যাবার সিঁড়িটা চোখে পড়ল।   মনে হল সোমাদির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কিছু না হোক কুড়ি বছরের, আর সেই সুবাদে ফারহাদ দাকেও বছর বারো, চোদ্দ চিনি। কতবার ওদের দোকানে এসেছি। কিন্তু ঈদের সময় বোধহয় আসা হয়নি কখনো। সোমা দি বহু বার ঈদে যেতে বলেছে ওর বাড়ি, জীবনের নানা ব্যস্ততায় সেটাও গিয়ে উঠতে পারিনি। আক্ষেপ হচ্ছিল ইস ঘন্টাখানেক থেকে এলেই হতো। সেই তো এ চত্ত্বর থেকে বেরোতে বেরোতে বেশ দেরিই হলো।  হঠাৎ দেখি সেই পেছন থেকে ফিসফিস করে কথা বলা ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। হাতে আতিব বা আফতাব কি যেন লেখা প্যাকেট। হাসি পেলো আমার। নাক কানটা  ভালো করে মুছে নিলাম, যেখান দিয়ে একরাশ কালো ধোঁয়া আর ফিসফিসে, হিলহিলে শব্দগুলো ঢুকেছিল।  জনস্রোতের সঙ্গে এগোতে এগোতে ভাবছিলাম আমরাও তো কম করিনি। মুসলমান বাড়িতে আমার কজন পূর্বপুরুষ খেয়েছে, আমরাও তো বাড়িতে আসা মুসলমান অতিথির খাওয়া থালা বাটি রান্না ঘরে ঢোকাইনি। আমরাও ঈদে যাইনি ওরাও দুর্গা পুজোয় আসেনি। কিন্তু এই 'ওরা' এই ’আমরাই' কী ভারতবর্ষ নাকি ভারত মানে সেই নারায়ণ নামের কর্মচারী যার মা তৌফিককে বেগুনী ভেজে পাঠায় ইফতার করবে বলে, নাকি দোকানের সেই মেয়েটি যে ঈদের জামার সঙ্গে দুর্গাপুজোর জামারও বায়না করে, নাকি ভারতবর্ষ মানে সোমা দি ফারহাদ দার সন্তান যাদের বাবার সঙ্গে ঈদ পালনও  আছে আবার শ্রীরামপুরে মামাবাড়ি গিয়ে ঠাকুর দেখাও আছে। নাকি আমার  ভাররবর্ষ মানে শ্রান্ত পথিকের হাতে পড়া চার পাঁচটি ভিজে ছোলা অথবা বাতাসা  আর আর এক গেলাস লাল শরবৎ। ঈদের আগাম শুভেচ্ছা!  সকলকে। 'ওদের' তো বটেই আমাদেরও।

আমরা তো অল্পে খুশি

এই রাত বারোটায় আমার বাড়ির লাগোয়া পুকুরে প্রচন্ড জোরে ভোজপুরি গান বাজিয়ে গণেশ ভাসান হচ্ছে। অথচ আমি অদ্ভুত প্রশান্ত। আমি জানি এ জীবন থেকে আর আমার মুক্তির উপায় নেই। এই ভোজপুরি গান, ডিজে বক্স, রাস্তা বন্ধ করে পুজো, প্রচন্ড জ্যাম, ভাঙা ব্রিজ, এবড়োখেবড়ো রাস্তা, অটোওলাদের অসভ্যতা, বেপোরয়া বাস, বিভৎস উল্লাস ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি। ধরে নিয়েছি এইটুকুই শহরে থাকার সুখ। সত্তর বছর ধরে এ দেশে মানুষ এ ভাবেই আছে।  আমার মত গ্রাম থেকে  শহরে মাইগ্রেটেড বাসিন্দারা ভুলেও ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখবেন না। দেখবেন আপনার প্রশান্ত ভূমিতেও ছড়িয়ে পড়ছে গণেশ বন্দনার সুর। এসবে আমার কোনও অভিযোগ নেই। কার ওপরেই বা রাগ করব। যাদের চোখের সামনে দেখি তারা তো আমারই মত অদৃশ্য সুতোতে বাঁধা পুতুল মাত্র। কখন যে জড়িয়ে গেছে সে সুতোতে নিজেও জানেনা।
ফেসবুকে সাঁটা অন্যের ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া এ জীবনে আছেটাই বা কী! সুইমিংপুল আর জিমওয়ালা হাউজিং কমপ্লেক্সে ফ্লাট নেই, বাড়িতে পোষা পাগ নেই, ফাইভস্টার হোটেলে ডিনার নেই, বিরাট কাচের দরজাওয়ালা ড্রইংরুমে বসে দার্জিলিং চা নেই, নিদেন পক্ষে থার্ডপার্টি ইনসিওরেন্সের সেকেন্ড হ্যান্ড  গাড়িও নেই একখানা। কখনো সখনো গরীব রথে পুরী গেলে অথবা  ফ্লাইটে ত্রিপুরা গেলে শালার খুড়শ্বশুরও জানতে পারে সে কথা। বহুকাল ফ্লাইটের ট্যাগ ছিঁড়ে ফেলা হয় না বাক্স থেকে।  এ জীবনে তাই খুশি থাকতে গণেশ পুজোর প্যান্ডেলে শাঁখ বাজিয়ে ট্রফি জিততে হয়। চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখা মায়ার ওপারে চোখ যায়না আমাদের। তবু বলি আমরা তো অল্পে খুশি।
উদাহরণ হিসেবে একটা গল্প বলি। দীর্ঘ অটোর লাইন,  ঘোড়ার পেছনে বেধে দেওয়া মানুষের মত সাটেলের পেছনে  দৌড়, দু'একটি বাসে এক হাতে ঝুলতে ঝুলতে টালিগঞ্জ থেকে বেহালা ফেরা মানুষগুলো  হঠাৎ করে একটা নতুন বাসের সন্ধান পেয়েছেন। ব্রিজ ভাঙার পর মানুষগুলোর দুর্দশার কথা শুনে সরকারই সে ব্যবস্থা করেছেন। সকলে হয়ত বসতেও পারেন না সে বাসে।কিন্তু বিশ্বাস করুন  বাসের মানুষগুলোর মুখে যে হাসি আমি প্রথমদিন বাস চালু হবার পর আমি দেখে ছিলাম  তা সন্তান জন্মবার পর প্রথম  হাতে নেওয়া মায়ের মুখের হাসির চেয়ে কম প্রশান্তির, কম সন্তুষ্টির নয়। আমিও সেদিন ভারি খুশি ছিলাম এ উদ্যোগে। আমার মন সারা বাস বলে গেলো  'আমরা তো অল্পে খুশি, কি হবে দুঃখ করে, আমাদের দিন কেটে যায় সাধারণ ভাত কাপড়ে'।

গভীর সাহিত্য মেয়েদের কম্ম নয়



আমার স্থির বিশ্বাস গভীর সাহিত্য মেয়েদের কম্ম নয়। মেয়েদের জীবনের অভিজ্ঞতাই নেই,exploration of life মেয়েদের কোথায়! তাই মেয়েদের কলমের ডগা থেকে শ্রীকান্তের বার্মা যাত্রার বর্ণনা বেরোয় না, তারাপদর মত যাত্রাদলের যোগ দেবার অভিজ্ঞতার কথা বেরোয় না, পূর্ণিয়ার জঙ্গলে বসে অরণ্য উপলব্ধির কথা লিখে ওঠে না মেয়েরা। এমনকি মেয়েদের মুক্তির কথাও লিখতে হয় ইবসেন অথবা রবীন্দ্রনাথকে।
মেয়েরা লিখবে কি করে, ওরা জানেটা কি! বলশেভিক আন্দোলন জানেনা, থিয়োরি অফ আলিয়েনেশন জানে না,মিখাইল গোরবাচভ জানে না,  সিরিয়া, লেবানন, সাদ্দাম হুসেন, চীনের  অর্থনীতি, ইউ পি এ- র সঙ্গে এন ডি এ-র তফাৎ এসব কিচ্ছু জানে না। মেসি কোন ক্লাবে খেলে, ডার্ক ওয়ার্থ লুইস কি, প্যাট ক্যাস অথবা বিলিজিন কিং কে, ফিফটিন- লভ আসলে কি, জেমস বন্ড সিরিজের প্রথম নায়ক কে, লেডি গা গা কে, ব্লাক হোল থিওরি আসলে কি, বায়ো স্টাট কোথায় ভালো পড়ায়, গান্ধী - সুভাষের সম্পর্কের অবনতি এসব কোন খবর মেয়েরা জানে! তাহলে তারা কি নিয়ে লিখবে শুনি! কেবল ওই ঘটি বাটি কুটনো কুটি! আহা আমি যে বেচারি এই এক কথা!
সেই কবে জন্মের পর আয়ামাসি একফালি সাদা ন্যাকড়া দিয়ে বলেছিল ঢেকে রাখতে হয়, তারপর থেকে বেচারিদের ত্রিভুজ রক্ষে করতেই জীবন চলে গেলো। তাই আর বাড়ি থেকে পালানো হল না, মাঠে গিয়ে উইকেট পোঁতা হলো না, ঘুম চোখে চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজ পড়া হলো না, বেশ্যা পাড়ার গলি চেনা হলো না, বি এম ডাব্লু মিনি আর হুন্ডাই আই টেনের মডেলের তফাৎ বোঝা হলো না আরো কত্ত কি হলো না!
তবু ওরা লেখে,খুন্তি কড়াইয়ের সখ্যর কথা লেখে, কলসি থেকে জল গড়ানোর শব্দের কথা লেখে, প্রবাসে থাকা প্রিয়র জন্য অপেক্ষার কথা লেখে, নিবেদিত ত্রিভুজের যন্ত্রনার কথা লেখে,স্বজনের কথা লেখে, প্রেমের কথা লেখে,সন্তানের কথা লেখে, তবু ওই লেখাই হয়, মেয়েমানুষরা উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে না এ নাকি সর্বজনবিদিত!
লেখক নীলা।
২৮.০৬.১৭